রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে তিক্ততা চরমে উঠল শাসক দলের। বিরোধী বামেদের স্বার্থে কাজ করার অভিযোগ এনে সরাসরি রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে ‘সিপিএমের লোক’ বলে আক্রমণ করলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়!
বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কোনও রাজ্য সরকার বা শাসক দলের সংঘাতের নজির সুলভ। কিন্তু পঞ্চায়েতের মতো স্থানীয় পর্যায়ের ভোটকে কেন্দ্র করে রাজ্যের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সরকার তথা শাসক দলের এমন বিরোধের দৃষ্টান্ত সাম্প্রতিক কালে নেই। প্রশাসনিক মহলের অনেকেই এই বিবাদকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজ্যের নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে দুই মহিলার ব্যক্তিত্বের সংঘাত হিসাবে দেখছেন। তবে মুকুলবাবু রবিবার দাবি করেছেন, তাঁর বক্তব্য রাজ্য সরকারের নয়। তিনি তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দলের বক্তব্য জানাচ্ছেন। কমিশনকে কড়া আক্রমণ করলেও আলাপ-আলোচনার পথে মীমাংসায় পৌঁছনো যাবে বলেও আশাপ্রকাশ করেছেন তৃণমূলের এই নেতা। যা থেকে শাসক শিবিরেরই একাংশের ধারণা, রাজ্য নির্বাচন কমিশনের উপরে প্রবল চাপ রাখতেই তৃণমূল নেত্রী তাঁর বিশ্বস্ত নেতাকে দিয়ে এমন বিষোদ্গার করালেন। |
সাংবাদিক বৈঠকে মুকুল। তৃণমূল ভবনে রবিবার। —নিজস্ব চিত্র |
পঞ্চায়েত ভোট কবে এবং কত দফায় হবে, তা নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সরকারের টানাপোড়েন চলছিলই। তৃণমূলের দাবি মতো ভোট করতে না-চাওয়া বা রাজ্য সরকারের সঙ্গে মতান্তরের জন্য সরাসরি নির্বাচন কমিশনারকেই দায়ী করে মুকুলবাবু সেই বিরোধের মাত্রা চড়িয়েছেন। তৃণমূল ভবনে মুকুলবাবু এ দিন সরাসরি মীরাদেবীর নাম না-করে অভিযোগ করেন, “২০১০ সালে তৎকালীন বাম সরকারের সুপারিশে এই কমিশনার মহোদয়া নিযুক্ত হয়েছিলেন। ফেব্রুয়ারিতে ভোট হলে বামেদের হার সুনিশ্চিত ছিল! সুপারিশকারী দলের হার বিলম্বিত করতেই তাই বারবার ভোট পিছিয়ে দিচ্ছেন কমিশনার!” বামেদের সঙ্গে ‘সুসম্পর্কে’র খাতিরেই মীরাদেবীর নির্দেশে ভোটার তালিকা নিয়ে অভিযোগ জানানোর মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও সিপিএমের অভিযোগ জমা নেওয়া হয়েছে বলে মুকুলবাবু অভিযোগ করেছেন।
ঘনিষ্ঠ মহলে মীরাদেবীকে ‘জেদি মহিলা’ বলেই উল্লেখ করছেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। বরাবরই তাঁরা এক দফায় ভোটের পক্ষে। কমিশন চাইছে তিন দফায় ভোট হোক। কিন্তু কমিশনের আপত্তি সত্ত্বেও তৃণমূল এক দফায় ভোটের দাবিতেই অনড় থাকছে বলে এ দিন আরও এক বার জানিয়ে দিয়েছেন মুকুলবাবু। বস্তুত, কমিশনের বারবার আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সরকার দু’দফায় ভোটে রাজি হয়ে তাদের চিঠি পাঠিয়েছিল। তবে সেই দু’দফার জেলাওয়াড়ি বিন্যাস এমন ভাবে করতে চেয়েছিল সরকার, যা কমিশনের পছন্দ হয়নি। মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর, কমিশন তার অবস্থানে অনড় থাকলে সরকারও নিজেদের পুরনো অবস্থানে ফিরে গিয়ে, ২০০৮ সালের আইনের সুযোগ নিয়ে এক দফায় ভোটের জন্য সরকারি প্রক্রিয়া চালু করে দিক এমনই চাইছেন মমতা।
মীরাদেবী অবশ্য তাঁর সম্পর্কে মুকুলবাবুর অভিযোগের জবাবে মুখ খুলতে চাননি। তবে রাজ্য নির্বাচন কমিশন সূত্রের খবর, আজ, সোমবারই জরুরি বৈঠকে বসতে পারে তারা। নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে যে নজিরবিহীন ভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে, তার কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠি দেওয়ার কথা ভাবছে তারা। কমিশন সূত্রেই আরও বলা হচ্ছে, মীরাদেবী এই পদে দায়িত্ব নিয়েছিলেন ২০০৯-এর এপ্রিলে। তাঁর আমলেই কলকাতা-সহ ৫০টির বেশি পুরসভা জিতেছে তৃণমূল। তা হলে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে বামেদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ওঠে কী ভাবে? |
ভোট তরজায় ম-ম |
বাম সুপারিশে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ফেব্রুয়ারিতে ভোট হলে
বামেরা সুনিশ্চিত ভাবে হারত। সুপারিশকারীর হার বিলম্বিত
করতেই
বারবার ভোট পিছিয়ে দিচ্ছেন। মুকুল রায় |
|
|
|
|
|
|
এটা অসাংবিধানিক
ও অগণতান্ত্রিক।
ভিত্তিহীন
অভিযোগ
আনার
আগে
সংবিধানটা ভাল
করে
পড়া
উচিত।
সূর্যকান্ত মিশ্র |
মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন,
বাম আমলে
গর্ভবতী
হলে
শিশু-মৃত্যুর
দায়
তাঁর
সরকারের
নয়।
সেই
পরম্পরাই
চলছে!
মহম্মদ সেলিম |
কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে
তিন দিনে
ভোট
হলে
পর্যুদস্ত
হওয়ার
আশঙ্কা
শাসক
দলে।
কমিশনকে
আক্রমণ
তা
ঠেকাতেই।
প্রদীপ ভট্টাচার্য |
তা হলে ওঁদের আমলে
নিযুক্ত অফিসাররা কি
ওঁদেরই কথা
শুনে
চলছেন? এই
অবান্তর
কথার
মানে
হয় না!
রাহুল সিংহ |
|
|
|
আগামী বছর এপ্রিলে অবসর নেওয়ার কথা মীরাদেবীর। আমলা মহলের একাংশের ধারণা, এর পর নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েও রাজ্য সরকারকে বিড়ম্বনায় ফেলতে পারেন এই আধিকারিক।
শাসক দলের অভিযোগের জবাবে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেছেন, “ওঁদের জানা উচিত, ভাল-মন্দ যা-ই হোক, আমলারা পাকাপাকি সরকারের অঙ্গ। একটা নতুন সরকার যখন নির্বাচিত হয়ে আসে, প্রশাসনিক আধিকারিকদের নিয়েই যথাসম্ভব কাজ করে। সবাই কি এসেই ইকবালদের প্রশাসনে বসায়? এই সরকার তা হলে গোড়ার দিকে বাম আমলের মুখ্যসচিবকে নিয়ে কাজ করত কেন?” সেলিমের যুক্তি, কোন আমলে নিয়োগ হয়েছে, সেটা বড় কথা নয়। নির্বাচন কমিশন তার নিয়মে চলে। তৃণমূলের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন কংগ্রেসের প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যও। তাঁর বক্তব্য, “কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে তিন দফায় ভোট হলে শাসক দল পর্যুদস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে! সেটা ঠেকাতেই তারা এখন মরিয়া। সেই জন্যই অহেতুক রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে আক্রমণ করছে।” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের প্রশ্ন, “কমিশনার বাম আমলে নিযুক্ত বলে সিপিএমের কথা শুনছেন, এটা যদি বক্তব্য হয়, তা হলে ওঁদের আমলে নিযুক্ত অফিসাররা কি ওঁদেরই কথা শুনে চলছেন?”
মুকুলবাবু এ দিন কমিশনারের কাছে জানতে চেয়েছেন, “ফেব্রুয়ারিতে ভোট করলে কী অসুবিধা ছিল বলুন!” কমিশনের তরফে কোনও জবাব না এলেও সেলিম এবং প্রদীপবাবু বলেন, সেই সময় মাধ্যমিক-সহ নানা পরীক্ষা থাকে। যার সূচি তৈরি হয়ে যায় অন্তত এক বছর আগে। তা ছাড়া, নতুন যে ভোটার তালিকায় পঞ্চায়েত ভোট হবে, তা চূড়ান্ত ভাবে প্রকাশিতই হয়েছে জানুয়ারিতে। তা হলে ফেব্রুয়ারিতে ভোট হত কী ভাবে? যদিও মুকুলবাবুর যুক্তি, ২৫ ফেব্রুয়ারি মাধ্যমিক শুরু হয়েছিল। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নির্দেশ অনুযায়ী, ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাইক বাজিয়ে প্রচার করা যেত। ৫ জানুয়ারি ভোটার তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল। তার ১৫ দিনের মধ্যে কমিশন ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারি করলে ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভোটপর্ব মিটে যেতে পারত। |