চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, কেপমারি, খুনের চেষ্টা, পাচার, বোমাবাজিগত এক বছর ধরে বনগাঁ থানা এলাকায় একের পর এক অপরাধমূলক কাজকর্মের সাক্ষী শহরবাসী।
২০১২ সালের ২৫ মে শহরের প্রাণকেন্দ্র বাটার মোড়ে একটি সোনার দোকানে ভয়াবহ ডাকাতির পর বদলি হয়ে গিয়েছিলেন বনগাঁ থানার আইসি এবং বনগাঁর এসডিপিও জয়ন্ত মুখোপাধ্যায়। তার পর বনগাঁ থানার আইসি হয়ে আসেন জাফর আলম। কিন্তু আইসি বদল বলেও অপরাধজগতের কাজকর্মে তার কোনও প্রভাব দেখা যায়নি। সম্প্রতি ওই আইসি-কেও বদলি করে দেওয়া হয়েছে। নতুন আইসি হিসাবে রবিবার দায়িত্ব নিয়েছেন চন্দ্রশেখর দাস। অতীতে তিনি এই এলাকায় কাজ করে গিয়েছেন। এখানকার অপরাধ জগতের কাজকর্ম নিয়ে তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণেই তাঁকে ফের বনগাঁয় নিয়ে আসা হল বলে ধারণা এলাকার মানুষের। গত এক বছরে যে ভাবে বনগাঁ শহরে অপরাধ বেড়েছে তাতে তাঁর দিকেই তাকিয়ে শহরবাসী।
যদিও কাজ যে বেশ কঠিন তা মানছেন সকলেই। কারণ শনিবার রাতেই শহরের হীরামহল গলিতে একটি সোনার দোকানে ডাকাতির চেষ্টা হয়। দোকানের জানালার গ্রিলও ভেঙে ফেলে দুষ্কৃতীরা। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। স্থানীয় সূত্রের খবর, ওই দিন রাত দেড়টা নাগাদ ৭-৮ জনের একটি দুষ্কৃতী দল এলাকায় ঢোকে। |
তাদের সকলের পরনে ছিলে পুলিশের পোশাক। মাথায় পাগড়ি। নিজেদের মধ্যে তারা হিন্দিতে কথা বলছিল। রাত ২টো নাগাদ বনগাঁর দীনবন্ধু নগরের বাসিন্দা নকুল দাস হীরামহল গলি দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। দুষ্কৃতীদের একজন তাঁর কাছে আগুন চান। পুলিশের পোশাক দেখে নকুলবাবু আগুন দিতে যান। অভিযোগ, তখনই দুষ্কৃতীরা তাঁর মুখ চেপে ধরে পিছমোড়া করে বেঁধে মারধর করে রাস্তায় ফেলে রাখে। ইতিমধ্যে সেখানে এসে পৌঁছন অভিজিৎ সরকার। স্থানীয় বাসিন্দা অভিজিৎবাবু কাটোয়ায় যাবেন বলে ভোররাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওই রাস্তা দিয়েই স্টেশনের দিকে যাচ্ছিলেন। দুষ্কৃতীরা তাঁকে ধরে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। অভিজিৎবাবুর চিৎকার শুনে এলাকায় রাত পাহারার কাজে থাকা সুভাষ নাথ ছুটে গেলে তাঁকেও মারদর করে দুষ্কৃতীরা। অভিজিৎবাবুর দাদা জয়ন্তবাবু বলেন, “ভাইয়ের চিৎকার শুনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চিৎকার করতে করতে ছুটে গেলে ওরা পালিয়ে যায়। প্রত্যেকের পিঠে ব্যাগ ছিল।”
রবিবার সকালে এলাকায় যান বনগাঁর প্রাক্তন বিধায়ক গোপাল শেঠ-সহ অন্যান্য ব্যবসায়ীরা। আসেন বনগাঁর এসডিপিও রূপান্ত সেনগুপ্ত। বনগাঁয় আইন-শৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে পুলিশের সামনেই অভিযোগ করেন গোপালবাবু। তিনি বলেন, “রাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দুষ্কৃতী-দৌরাত্ম্য ক্রমাগত বাড়ছে। চুরি-ছিনতাই রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবিলম্বে এ সবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে বলা হয়েছে।” বনগাঁয় যে ভাবে সোনার দোকানে ডাকাতি বাড়ছে তাতে উদ্বিগ্ন স্বর্ণ ব্যবসায়ী সমিতি।সমিতির সম্পাদক দিলীপ মজুমদার বলেন, “এক বছরে বনগাঁ শহর এবং মহকুমায় পর পর সোনার দোকানে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। আমরা তাই আতঙ্কিত। যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে দোকান বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আমাদের কাছে বিকল্প পথ নেই।” পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে তাঁর মন্তব্য, “ওঁরা বলেন তদন্ত হচ্ছে। দুষ্কৃতীরা শীঘ্রই ধরা পড়বে। কিন্তু দুষ্কৃতীরাও গ্রেফতার হয় না। আর মালপত্রও উদ্ধার হয় না।”
স্থানীয় বাসিন্দারা এবং ব্যবসায়ীদের একাংশ অবশ্য বনগাঁ শহর ও শহর লাগোয়া এলাকায় দুষ্কৃতীদের এমন বেপরোয়া তাণ্ডবের জন্য পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার দিকে আঙুল তুলেছেন। তাঁদের অভিযোগ, পুলিশ থাকা সত্ত্বেও রাত ১২টার পরই বনগাঁ শহর কার্যত দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়। গরু পাচার থেকে শুরু করে নানা অপরাধ করে দুষ্কৃতীরা গাড়ি চেপে শহরে দাপিয়ে বেড়ায়। রাজনৈতিক দলাদলি ও দুষ্কৃতীদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জন্য আনাগোনা বেড়েছে সুপারিকিলারদেরও। তারই পরিণতি, সম্প্রতি মহকুমায় বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুলিশের ভূমিকা গতানুগতিক। অপরাধ কমাতে পুলিশকে সে ভাবে সক্রিয় ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। বাসিন্দাদের আরও ক্ষোভ, পুলিশের একাংশের সঙ্গে গরু পাচারকারীদের যোগসাজশ নিয়ে। তাঁদের অভিযোগ, পাচারকারীদের হাত ধরেই অপরাধমূলক কাজকর্ম বাড়ছে। আর তাদের সঙ্গে যোগসাজশের কারণে পুলিশও সে ভাবে কড়া হতে পারছে না। পাশাপাশি, কোনও অপরাধ নিয়ে থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে ওপর মহলের কোনও তদ্বির না থাকলে গুরুত্বই দেওয়া হয় না বলেও অভিযোগ স্থানীয় মানুষের। সম্প্রতি এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই অভিযোগকারিণীর বক্তব্য, “আমি প্রথমে থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে তা নেওয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির কাছে গেলে তিনি থানার আইসি-কে ফোনে নির্দেশ দিলে অভিযোগ নেওয়া হয়। সেই সঙ্গে আমাকে থানায় বলা হয়, ‘ওই জনপ্রতিনিধির কাছে যখন গিয়েছেন, তখন উনিই আপনার সমস্যা মেটাবেন’।” এ সব কারণেই কিছুদিন আগে বনগাঁ থানায় ভাঙচুরের ঘটনাকে রাজনৈতিক কারণের পাশপাশি পুলিশের বিরুদ্ধে বাসিন্দাদের একাংশের ক্ষোভ বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।
পুলিশের বিরুদ্ধে বাসিন্দাদের ক্ষোভ যে বাড়ছে তার প্রমাণ, ঘটনার দিন কয়েক পরেই কালুপুরে প্রকাশ্যে গরু পাচারকারীদের কাছ থেকে তোলা নেওয়ার অভিযোগে কয়েকজন পুলিশকর্মীকে আটকে রাখেন বাসিন্দারা।
পুলিশের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ যে বাড়ছে তা স্বীকার করেছেন বনগাঁ উত্তর কেন্দ্রের বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস। তিনি বলেন, “বনগাঁ থানার আইসি-সহ কয়েকজন পুলিশকর্মীকে দিন কয়েক আগে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। থানাও ঢেলে সাজা হচ্ছে। আশা করি, এ বার এলাকার মানুষ থানার কাছে ভাল পরিষেবা পাবেন।”
আর জনতার আদালতে কাঠগড়ায় ওঠা পুলিশ কী বলছে?
পুলিশ প্রশাসন সূত্রে খবর, সীমান্ত এলাকা বনগাঁ শহরে টহলদারির জন্য রয়েছে দু’টি গাড়ি। কিন্তু পর্যাপ্ত তেলের অভাবে টহলদারির কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। অভাব রয়েছে পর্যাপ্ত পুলিশকর্মীর। পুলিশের এক পদস্থ কর্তা বলেন, “সাধারণ মানুষের ক্ষোভ স্বাভাবিক। কারণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের উপরেই রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে যে পরিকাঠামো রয়েছে তাতে সদিচ্ছা থাকলেও কোনও উপায় নেই। কিন্তু তবু আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।” সেই সঙ্গে তিনি জানান, দুষ্কৃতীদের ঠেকাতে কয়েকটি এলাকায় আর জি পার্টি তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে।”
জেলার পুলিশ সুপার সুগত সেন বলেন, “শনিবার রাতের ঘটনার তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এসডিপিওকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য সমস্যাও মেটাতে ব্যবস্থা হচ্ছে।”
পুলিশ সুপারের এমন কথায় অবশ্য তেমনটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছেনা না নিরাপত্তার খাতিরেই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গৃহবধূ। তিনি বলেন, “গত এক বছর ধরে জেলার পুলিশ কর্তাদের মুখে এমন কথা বার বার শুনেছি। কিন্তু তার কী ফল হয়েছে তা বনগাঁর মানুষ নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন।” তাঁর আরও বক্তব্য, “মেয়েকে কোচিং ক্লাস থেকে নিয়ে ফিরতে রোজই রাত হয়। যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে প্রতিনিয়ত আতঙ্কে থাকি। এ ভাবে তো বাঁচা যায় না।” |