এক জন চান বাবার খুনিদের শাস্তি, অন্য জন খুনে মদত দেওয়ার অভিযোগ থেকে বাবার অব্যাহতি।
নিহত সাব ইনস্পেক্টর তাপস চৌধুরীর মেয়ে তনুশ্রী আর তাপস খুনের ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নার মেয়ে সাবা। কুড়ি আর একুশ বছরের দুই কন্যার স্বার্থ এখন পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। কোনও এক জনের হারে নির্ধারিত হবে অন্য জনের জিত। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে ওঁদের দু’জনের কারও জন্য আক্রোশ নেই। বরং জিজ্ঞেস করলে দু’জনেই অন্যের সম্পর্কে বলছেন, “ওর জায়গায় থাকলে ও যা করছে, আমিও তাই করতাম!”
তনুশ্রী আর সাবা, প্রায় সমবয়সী দু’জনেই। দু’জনেরই জীবন কাটছিল মোটের উপর নির্ঝঞ্ঝাটে। কিন্তু দু’টো জীবনই ওলটপালট করে দিয়ে গেল ১২ ফেব্রুয়ারির দিনটা। আর দু’জনেই এক ধাক্কায় বড় হয়ে গেলেন।
বটানির প্রথম বর্ষের ছাত্রী তনুশ্রী কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে শুনলেন, আততায়ীর গুলি শেষ করে দিয়েছে বাবাকে। সাংবাদিকতার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সাবা তখন টেলিভিশনে পাগলের মতো চ্যানেল পাল্টে যাচ্ছেন। আর প্রায় প্রত্যেকটাতেই ভেসে উঠছে বাবা ইকবালের মুখ।
রবিবার দুপুরে তনুশ্রী বলছিলেন, “আমার মাথাটা তখন ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। যা যা ঘটে যাচ্ছিল, তার মধ্যে যন্ত্রের মতো আচরণ করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু একটা সময় বুঝলাম, লড়াইয়ের সিদ্ধান্তটা নিতে হবে।”
আর সাবা? প্রশ্নটা শুনে তাঁর মুখে কান্নাচাপা একটা হাসি খেলে যায়। বলেন, “পাপা-র সবচেয়ে আদরের ছিলাম আমি। প্রথম দু’দিন ভয়ে কুঁকড়ে থেকেছি। তার পর বোধহয় উপরওয়ালাই শক্তি দিলেন।” |
ইকবাল-কন্যা সাবা (বাঁ দিকে) ও তাপস চৌধুরীর মেয়ে তনুশ্রী। |
আচমকা নেমে আসা বিপর্যয়ের মুখে দুই মেয়েরই উপলব্ধিটা কিন্তু এক। তনুশ্রীর কথায়, “এক দিনের মধ্যে তনু থেকে তনুশ্রী হয়ে গিয়েছি। মা-ভাই সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।” বাবার মৃত্যুর দিনেই তনুশ্রীকে টিভি চ্যানেলে বক্তব্য রাখতে হয়েছে। বাড়িতে পুলিশ-প্রশাসন-সংবাদমাধ্যমের আনাগোনা সামলাতে হয়েছে। আর, অভিযুক্ত বাবার হয়ে মুখ খুলতে এগিয়ে আসতে হয়েছে সাবাকেই। “উপায় ছিল না, জানেন! মা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। দুই ভাই, সামস (এরই আর এক নাম অনিল, এখন পলাতক) আর সেফ আমার থেকেও ছোট। তার মধ্যে বাবার পাশাপাশি সবাই সামস-এর দিকেও আঙুল তুলতে লাগল। ববি আঙ্কল সরে গেলেন। বাবার পাশে আমাকে দাঁড়াতেই হল।”
বাবাদের জন্য লড়তে গিয়ে দুই মেয়েই এক রকম করে বাবাদের দুনিয়াতেও যেন ঢুকে পড়লেন অনেকটা। বটানির ছাত্রী তনুশ্রী এখন পুলিশে চাকরি করছেন। সাবাও যে ভাবে বাবার কাজকর্ম সামলাচ্ছেন, বাবার জন্য বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাতে ভবিষ্যতের রাজনীতিককেই দেখতে পাচ্ছেন অনেকে। রাজনীতিতে আসবেন সাবা? সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন ভুলেছেন, তবে রাজনীতি করবেন কি না, সিদ্ধান্ত নেননি এখনও।
সাবার এই লড়াইকে কী ভাবে দেখছেন পিতৃহারা তনুশ্রী? দীর্ঘশ্বাস ফেলে তনুশ্রী বলেন, “সাবা-র জায়গায় আমি থাকলে হয়তো ও যেটা করছে সেটাই করতাম। ওর উপর আমার কোনও ক্ষোভ নেই। ওর ঘাড়েও হঠাৎ পরিবার-মা-ভাইয়ের দায়িত্ব এসে পড়েছে, আমারও তাই।” তনুশ্রী অবশ্যই চান, তাঁর বাবার খুনিরা শাস্তি পাক। “নইলে রাতে ঘুম হবে না আমার,” বললেন তিনি। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও বোঝেন, “সাবার কাছেও ওর বাবা এখন প্রায়োরিটি। তাঁকে বাঁচাতে সাবা ১০০ শতাংশ চেষ্টা করবে। সেটাই উচিত।”
সাবাও একই রকম ভাবে বলছেন, “আমি জানি কতখানি চাপের মধ্যে দিয়ে তনুশ্রী যাচ্ছে। আমাদের দু’টো পরিবারই তো ছারখার হয়ে যাচ্ছে।” সাবা তনুশ্রীর সঙ্গে দেখা করতেও চেয়েছিলেন প্রথমে। জানালেন, ইকবাল নিজেও তনুশ্রীদের বাড়ি যেতে চেয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যমের চাপ, রাজনৈতিক দাদাদের পরামর্শ সব মিলিয়ে হয়ে ওঠেনি।
তনুশ্রী বলে চলেন, “বাবা খুব নির্বিবাদী ছিলেন। কোনও দিন উঁচু গলায় কথা বলতে শুনিনি। সেই বাবাকে কে বা কারা খুন করে ফেলল। শুনলাম তদন্তকারীরা নাকি জানিয়েছেন, বাবা অনেক ক্ষণ ধরে হামলাকারীদের বাধা দিচ্ছিলেন বলে টার্গেট হয়ে গিয়েছিলেন। তাই ওরা বাবাকে গুলি করেছে।” আপাতত তদন্ত যে ভাবে এগোচ্ছে বা সিআইডি যে ভাবে মুন্নাকে বিহার থেকে ধরেছে, তাতে তনুশ্রী খুশি। সে কথা শুনে সাবার প্রতিক্রিয়া? “হয়তো আমি তনুশ্রীর জায়গায় থাকলে এই রকমই বলতাম। আমরা দু’জন আলাদা-আলাদা লড়াই লড়ছি। পাপাকে হারানো সম্মান ফিরিয়ে দিতে হবে, এটা আমার কাছে আমার চ্যালেঞ্জ।”
বাবাদের জন্য বিচার চেয়ে মুখোমুখি দাঁড়ানো দুই মেয়ে। কোনও এক জনের হারে নির্ধারিত হবে অন্য জনের জিত।
সাবার কথায়, “আমি তনুশ্রীকে বলতে চেয়েছিলাম বিশ্বাস করো, আমার বাবা এমন কাজ করতেই পারেন না। যদি করতেন, তা হলে আমি অন্তত বাবার হয়ে লড়াই করতে যেতাম না।”
আর তনুশ্রী? তিনি কি দেখা করতে চান সাবার সঙ্গে? বললেন, “না চাইতেই অদ্ভুত একটা অবস্থার মধ্যে চলে এসেছি আমরা দু’জন। তাই এখনই ওর মুখোমুখি হতে চাই না। কী জানি, কী বলে ফেলব। হয়তো ওকে দুঃখ দিয়ে ফেলব।” |