ছোটাছুটির অন্ত নেই। খামার পরিদর্শন, দুর্যোগের রিপোর্ট তৈরির জন্য এলাকা ঘুরে দেখা, আলোচনাসভা আয়োজন, মেলার বন্দোবস্তদায়িত্বের তালিকা বেশ লম্বা। এ সব কাজে যাতায়াতের জন্য দফতরের সামনে সব সময় দাঁড়িয়ে রয়েছে জিপ। তবে দাঁড়িয়ে থাকাই সার। অফিসার-কর্মীদের অধিকাংশ সময়েই যাতায়াত করতে হয় বাস, ট্রেন, রিকশায়।
হবে না-ই বা কেন। একে তো আদ্যিকালের নড়বড়ে জিপ, তার উপরে সেটির দেখভাল ও জ্বালানির জন্য সারা মাসে বরাদ্দ মাত্র চার হাজার টাকা। গত দু’দশকে এই বরাদ্দের পরিমাণ বাড়েনি। বিশাল এলাকা দেখাশোনা করতে তাই জিপের পরিষেবা বিশেষ পান না জেলার বিভিন্ন মহকুমার কৃষি দফতরের কর্মী-আধিকারিকেরা। তাঁদের দাবি, মহকুমার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে এক বার যাতায়াত করতেই বরাদ্দের এক-তৃতীয়াংশ শেষ হয়ে যায়। তাই ভরসা হয়ে দাঁড়ায় বাস, ট্রেনই। |
শস্যগোলা হিসেবে পরিচিত বর্ধমান জেলার নানা ব্লকে সারা বছর ধরেই বিভিন্ন ফসলে প্রদর্শনী ক্ষেত্র। সেগুলি কেমন চলছে, সে ব্যাপারে জেলা দফতরে নিয়মিত রিপোর্ট পাঠাতে হয় মহকুমা কৃষি দফতরকে। এ ছাড়াও অন্য নানা পরিদর্শন, কৃষি বিষয়ক সভা, ব্যাঙ্কে কৃষি বার্ধক্য ভাতার চেক পৌঁছনোর মতো কাজে যেতে হয় বিভিন্ন এলাকায়। তার জন্য রয়েছে পুরনো জিপ। তেলের খরচ ও জিপের যন্ত্রাংশ মেরামতির জন্য প্রায় দু’দশ ধরে মাসে চার হাজার টাকা পেয়ে আসছে মহকুমা কৃষি দফতরগুলি। কর্মী-আধিকারিকদের অভিযোগ, সব জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, কিন্তু জিপের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি।
কালনা কৃষি দফতরে রয়েছে এমনই একটি পুরনো জিপ। সেটি পেট্রোলে চলে। পেট্রোলের দাম ক্রমশ বাড়ায় এই জিপে চড়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে দফতরের আধিকারিকদের কাছে। এমনই এক আধিকারিক জানান, প্রতি লিটার পেট্রোলে জিপটি পাঁচ-ছয় কিলোমিটার যায়। পূর্বস্থলী ২ ব্লকের খামারে যেতে হলে প্রায় ১১০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে হয়। সে ক্ষেত্রে এক দিন জিপ চড়ার জন্য খরচ হয় হাজার দেড়েক টাকা। পুরনো জিপ ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটারের বেশি যেতে না পারায় দূরবর্তী ব্লকে পৌঁচতে অনেক সময় লেগে যায়। এই জিপের চালক উজ্জ্বল মুর্মু বলেন, “সব থেকে সমস্যা হয় গাড়ি খারাপ হলে। এলাকায় এই জিপের যন্ত্রাংশ না মেলায় বর্ধমানের একটি পুরনো গ্যারাজে যেতে হয়। সারা বছর গাড়ি খুব যত্নে রাখি। বিকল হলেই যে বিপদ।’’
কালনার মহকুমা কৃষি আধিকারিক স্বপনকুমার মারিক বলেন, “গাড়ির জন্য মাসে চার হাজার টাকা পাই। জেলা কৃষি আধিকারিকের অনুমতি পেলে ছ’হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করা যায়। তবে এই অনুমতি বছরে দু’এক বারের বেশি চাওয়া যায় না।” তা হলে মাস চলে কী ভাবে? তিনি বলেন, “বিভিন্ন প্রকল্পের কিছু টাকা ব্যবহার করা হয়। গাড়ির যন্ত্রাংশ আচমকা নষ্ট হয়ে গেলে খুব সমস্যা হয়। তখন জরুরি ভিত্তিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু টাকা চাইতে হয়।” স্বপনবাবুর দাবি, জিপ ডিজেল ইঞ্জিনে রূপান্তর করতে হলে মোটা টাকার দরকার। তা না থাকায় এই কাজ সম্ভব হয়নি। কালনা মহকুমা সহ-কৃষি অধিকর্তা নিলয় কর বলেন, “গাড়ি চাপা এত ব্যয়বহুল হওয়ায় মন্তেশ্বর, পূর্বস্থলীতে বিভিন্ন কাজে বাস, ট্রেনেই যাতায়াত করতে হয়।”
জেলা কৃষি দফতর সূত্রে জানা যায়, ১৯৬২ সাল নাগাদ বর্ধমানের কৃষি দফতর ৩৪টা জিপ কেনে। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে আট। তখন ৩৪ জন চালকও ছিলেন। এখন বর্ধমান সদর মহকুমায় দু’টি গাড়ি থাকলেও কোনও চালক নেই। কাটোয়া মহকুমা কৃষি দফতরে দু’টি গাড়ি থাকলেও বেশি খরচের জন্য কম ব্যবহার করা হয়। পুরনো জিপ ও এত কম বরাদ্দে মহকুমা কৃষি দফতরগুলির পক্ষে ব্লকগুলির কাজকর্ম তদারক কতটা সম্ভব, সে প্রশ্নে জেলার উপ-কৃষি অধিকর্তা শ্যামল দত্ত বলেন, “ব্লক কৃষি আধিকারিকদের কাজের সুবিধার্থে সম্প্রতি ভাড়া গাড়ি ব্যবহারের নির্দেশ কার্যকর হয়েছে। মহকুমার কার্যালয়গুলিতে সমস্যা রয়েছে। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।”
কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ব্লকের আধিকারিদের গাড়ি চড়ার যে নির্দেশে জানানো হয়েছে, এ জন্য দিনে ৯৬৫ টাকা পাওয়া যাবে। তার মধ্যে গাড়ি ভাড়া ৪৬৫ টাকা ও তেলের খরচ ৫০০ টাকা। নিয়ম অনুযায়ী, এক জন আধিকারিক মাসে সর্বোচ্চ ২৪ দিন ভাড়া গাড়ি চড়তে পারবেন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আপাতত পাঁচ মাসের জন্য এই ব্যবস্থা হয়েছে। এই বাবদ এক জন ব্লক কৃষি আধিকারিক সর্বোচ্চ মোট ১ লক্ষ ১৫ হাজার ৮০০ টাকা পেতে পারেন। তবে গাড়িটির বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমোদন থাকতে হবে। বহু ব্লকের আধিকারিকদের অবশ্য দাবি, গ্রামগঞ্জে বাণিজ্যিক ব্যবহারের গাড়ি মিলছে না। কালনা ২ ব্লকের আধিকারিক ভাস্কর দত্তের কথায়, “খরচ বেশি বলে অনেক মালিকই নিজেদের গাড়ি বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমোদন নেন না। আবার নির্দেশিক অনুযায়ী, আমরা সাধারণ গাড়ি চড়তে পারি না।” উপ-কৃষি অধিকর্তা শ্যামলবাবুর অবশ্য দাবি, মৌখিক ভাবে যে নির্দেশ রয়েছে যেখানে বাণিজ্যিক ব্যবহারের গাড়ি মিলবে না, সেখানে কাজের স্বার্থে সাধারণ গাড়ি ভাড়া করা যেতে হবে। |