ওঁরা পাতা তোলেন। পিঠে লম্বা ঝুড়ি। তাতে কচি পাতা। পাহাড়ের পায়ের কাছে ছড়িয়ে থাকা ওই মহিলারাই টিভি-সিনেমা-বিজ্ঞাপনে চা বাগানের মুখ।
কিন্তু সে মুখ অন্ধকার।
শ্রমিকসংখ্যার বিচারে দেশের দ্বিতীয় বড় শিল্প চা। ১২ লক্ষেরও শ্রমিক কাজ করেন, যার অর্ধেকেরও বেশি মহিলা। এ রাজ্যে ডুয়ার্সে আবার দেড় লাখেরও বেশি চা শ্রমিকের প্রায় ৬৩ শতাংশ নারী শ্রমিক। কিন্তু কেমন ভাবে জীবন কাটে তাঁদের? সেই জীবন চালু চা বাগানে এক রকম, বন্ধ বাগানে ঈষৎ আলাদা। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রুগ্ণ বাগানে, যেখানে না আছে শ্রম আইনের সুরক্ষা, না সরকারি বদান্যতা। ডুয়ার্সে খাতায়-কলমে পুরোপুরি বন্ধ চা বাগান এক মাত্র ঢেকলাপাড়া। যেখানে গত এক দশকে শ’খানেকের বেশি মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছেন বলে অভিযোগ। সেই বাগানের মেয়ে নীলু তাঁতি হিন্দি অনার্স পড়ে বীরপাড়া কলেজে। ছোট বয়সে সে-ও মায়ের সঙ্গে চা পাতা তুলতে যেত। এখন ব্লক থেকে রেশনের চাল-গম মেলে। মাথা পিছু সপ্তাহে ৬ কেজি চাল, ৪ কেজি গম। তাই দিয়েই কোনও রকমে চলে।
ওই বন্ধ বাগানেই ঘর সুনীতা নায়েকের। বছর চব্বিশের সুনীতার ছেলের বয়স ছয়, মেয়ে এখনও কোলে। স্বামী কাজ করেন কাছেই এথেলবাড়িতে এক কারখানায়। মাঝে-মধ্যে ১০০ দিনের কাজে যান সুনীতা। ১৩৫ টাকা রোজ। ঢেকলাপাড়ারই আর একটা ভাগ নিপানিয়া চা বাগানে শ্রমিক ছিলেন বছর চল্লিশের রুক্মিণী রহতোড়িয়া। এখন তাঁরা ব্যবসায়ীদের চুক্তিতে চা পাতা তুলে দেন। মোটামুটি এক বস্তায় (পোয়া) মেলে ৩৫ টাকা। এ ছাড়া জব কার্ড আছে। মাঝে-মধ্যে ১০০ দিনের কাজে খাটতে যান। |
নিপানিয়ার আর এক শ্রমিক, বছর পঁয়তাল্লিশের লছমি লোহারের সংসারে রোজগেরে বলতে একা তিনিই। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি “আমার স্বামী কিছুই করেন না। ৪০ টাকায় সব সময়ে কুলোয় না।” পাশেই ছিলেন সুধা কুমার। এলাকার পরিবার পরিকল্পনা প্রকল্পে যুক্ত তিনি। তাঁর কথায়, “এখানে বেশির ভাগ পরিবারই ওই ৪০ টাকা রোজে চালান মেয়েরা। ছেলেরা ১০০ টাকা বা তার বেশি রোজে বাইরের কারখানায় কাজ করতে যান।’’
চালু বাগানগুলিতে মেয়েরা ৯০ টাকা রোজে পাতা তোলা ও গাছের গোড়া পরিষ্কার করার কাজ করেন। ছেলেরা একই রোজে জলসেচ এবং কীটনাশক ছড়ানোর কাজ করেন। বেশি রোজে চা কারখানায় শিফটিং ডিউটিতেও যেতে পারেন তাঁরা। ১৯৫২ সালের প্ল্যানটেশন শ্রমিক আইন অনুযায়ী, দৈনিক মজুরি দেওয়া ছাড়াও রেশন, আবাসন, পানীয় জল, জ্বালানি, চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার কথা বাগান মালিকের। কিন্তু কোথাও চালু বা রুগ্ণ বাগানগুলিতে শ্রমিকেরা বহু সুবিধা পান না। সর্বত্র আবাসন থাকলেও তা থাকার যোগ্য নয়।
ডুয়ার্সের অন্যতম বড় বাগান ডিমডিমায় দরমার দেওয়াল ঘেরা একটি মাত্র ঘর বুধনি ওঁরাওয়ের। তাকেই বলে ‘কোয়ার্টার’। দরমার দেওয়াল ফুটো। রোদ-বৃষ্টি, বাইরের লোকের দৃষ্টি অনায়াসে গড়িয়ে আসে। সেই ঘরেই বেকার স্বামী আর পাঁচ শিশু নিয়ে বসত বাগান-শ্রমিক বুধনির। কোচবিহারের মেয়ে সীমা লাকড়া মাধ্যমিক পাশের পরে বিয়ে হয়ে চলে এসেছিলেন এক শ্রমিকের ঘরে। বাগানে না গিয়ে তিনি যুক্ত হয়েছেন একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সঙ্গে।
মাথায় রেশনের গমের বস্তা, পিঠে গামছা দিয়ে বাঁধা মাস তিনেকের শিশু নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক তরুণী। কাঁখে একটি শিশু। পায়ের কাছে ঘিরে আরও তিনটি। কিছু দিন আগে স্বামী মারা গিয়েছে তাঁর। এখানে পুরুষদের একটা বড় অংশই তাড়াতাড়ি মারা যান। যার কারণ মূলত দেশি মদ। কিন্তু তার আগেই চার-পাঁচটি শিশুর বাবা হয়ে যান। পরিবার পরিকল্পনার বালাই নেই। সীমার কথায়, “এদের বলে লাভ নেই! অপারেশন করাতেও যায় না।” মুজনাই চা বাগান হাসপাতালের পাশে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সহায়িকা সোমা সাহা বলেন, “পুরুষরা যেমন মরে যায় তাড়াতাড়ি, মেয়েদেরও অপুষ্টি। রক্তাল্পতা সাধারণ রোগ। মাতৃত্বকালীন মৃত্যু, শিশুমৃত্যুও হয়। সরকারি পরিবার পরিকল্পনাতেও তেমন সাড়া মেলেনি।”
রুগ্ণ মুজনাই বাগানের অবস্থা সব দিক থেকেই ভয়াবহ। তার মধ্যে সবচেয়ে দুরবস্থা থাকার জায়গার। শ্রমিক মীনাজ পান্না, পঞ্চমী ওঁরাওরা বলেন, “কোম্পানির কোয়ার্টারে থাকা যায় না। পঞ্চায়েত থেকে ইন্দিরা আবাস বা নিজভূমি নিজগৃহ প্রকল্পের বাড়ির বন্দোবস্ত হলেও তার জন্য বাগানের মালিকের সার্টিফিকেট লাগবে। কোথায় যাব আমরা?” অথচ এখান ছেড়ে যেতেও চান না তাঁরা। বেশির ভাগেরই কারণ মৃত স্বামীর স্মৃতি আর পিছুটান। মাঝবয়সী লক্ষ্মী দে বলেন, “অনেক মেয়েই যাচ্ছে কেরালা, পুণে, ভুটান। কিন্তু স্বামী-শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে কোথায় যাব?” হয়তো এই কারণেই তাঁদের এত কম পয়সায় খাটানো চলে। বাধ্য হয়ে বন্ধ চা বাগানের শ্রমিকেরা তৈরি করে নিয়েছেন বিকল্প জীবিকা। বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পাগলী, রেতি, চওয়ানের মতো নদী। বর্ষা ছাড়া সারা বছর শুকনোই থাকে। ভোর থেকে উঠে মেয়েরা, বাচ্চারা চলে যায় চরে। পাথর কুড়িয়ে পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা লরিতে তুলে দেয়। দিনে রোজগার ৩৫-৪০ টাকা।
কিছু দিন আগেই বন্ধ বাগান খোলা বা নিজেরা চালানোর দাবি নিয়ে কলকাতায় শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন ‘বাগান বাঁচাও শ্রমিক সমন্বয় কমিটি’র প্রতিনিধিরা। নিজেদের কথা জানিয়ে গিয়েছিলেন নিপানিয়ার শ্রমিক মেয়ে সিনা ওঁরাও। সংগঠনের কাজে শিলিগুড়িতে থাকায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। তাঁর পাশের ঘরের রুক্মিনী রহতোড়িয়াও সংগঠনে নাম লিখিয়েছেন। তাঁর কথায়, “সিনা লড়ছে আমাদের জন্য।” মিটিং-মিছিলে যান? রুক্মিণী বলেন, “যাব কখন? আমায় ছেলের জন্য রান্না করতে হয়। স্বামী যায়।”
স্বামীকে ছেলের ভার দিয়ে নিজে কবে বেরোবেন রুক্মিণী? |