তদন্তকারী অফিসারের অভাবে মামলার পাহাড় জমছে।
মহিলা পুলিশ অপ্রতুল বলে গত দু’বছরে ১০টির বেশি মহিলা থানা গড়তে পারেনি রাজ্য সরকার।
অনুমোদিত পদের তুলনায় কনস্টেবল এতই কম যে, নিত্যদিনের আইনশৃঙ্খলা সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে পুলিশ সুপারদের।
অথচ পুলিশের এই সব সমস্যায় নজর না-দিয়ে শুধু ‘সিভিক পুলিশ’ নিয়োগ করতে উঠেপড়ে লেগেছে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতর। জঙ্গলমহল থেকে এনভিএফ, হোমগার্ড ও ভিলেজ পুলিশ ভলান্টিয়ার নেওয়ার পরে এ বার রাজ্য জুড়ে এক লক্ষ ৩০ হাজার সিভিক পুলিশ নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে।
রাজ্য প্রশাসনের একাংশ বলছেন, সিভিক পুলিশ নিয়োগ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। কারণ তারা অপরাধী ধরতে পারবে না। তদন্তে সাহায্য করতে পারবে না। এমনকী থানায় প্রতিদিনের কাজেও হাত লাগাতে পারবে না। সিভিক পুলিশকে বড়জোর যান-শাসন, খেলা বা উৎসবে ভিড় সামলানোর কাজে ব্যবহার করতে পারবে জেলা প্রশাসন। স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা বলেন, “অপরাধী যাতে শাস্তি পায়, তার জমি তৈরি করাই পুলিশের মূল কাজ। এর জন্য অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে ৯০ দিনের মধ্যে চার্জশিট পেশ করতে পারলে তবেই মানুষ পুলিশের সদর্থক ভূমিকা টের পাবেন।” |
|
পুলিশের
হাল |
|
পদ |
অনুমোদিত |
আছে |
নেই |
এসআই |
৫১০০ |
৩৪৮৯ |
১৬১১ |
মহিলা এসআই |
৩৫৮ |
৯২ |
২৬৬ |
এএসআই |
৬৬৮৩ |
৪৫১০ |
২১৭৩ |
মহিলা এএসআই |
৪১৪ |
৯৪ |
৩২০ |
কনস্টেবল |
৫৫৮৯৪ |
৪৩৯৯৮ |
১১৮৯৬ |
মহিলা কনস্টেবল |
৮৪১১ |
১৭৩২ |
৬৬৭৭ |
|
স্বরাষ্ট্র দফতরের একাধিক কর্তা জানান, গত তিন বছরে রাজ্যে তদন্তকারী অফিসার নিয়োগ হয়নি। তদন্তের মূল দায়িত্ব যাঁদের, সেই সাব-ইনস্পেক্টরের সংখ্যা কমতে কমতে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, থানাগুলিতে এক-এক জনের হাতে গড়ে ৫০-৬০টি মামলা জমে গিয়েছে। এক পুলিশকর্তা বলেন, “পাঁচটি নতুন কমিশনারেট গড়া হয়েছে। বেশ কিছু থানার এলাকা ভেঙে তৈরি হয়েছে নতুন থানা। অথচ তদন্তকারীর সংখ্যা বাড়েনি। ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা মাঝপথে থমকে গিয়েছে।”
উদাহরণ হিসেবে রাজ্য পুলিশের এক ডিআইজি বলেন, “তিন বছর আগের জোড়া খুনের একটি মামলা শেষ না-হওয়ায় তদন্তকারী অফিসারকে ডেকে পাঠানো হয় মহাকরণে। নিজের দোষ কবুল করার সঙ্গে সঙ্গে ওই অফিসার নির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে দেখান, আরও ৩৫টি মামলা নিয়ে তিনি কতখানি নাজেহাল। সেই কারণে সে-দিনই চাকরি থেকে অব্যাহতিও চান ওই অফিসার।”
সরকারি তথ্য বলছে, ২০১২-র শেষে রাজ্যে মামলার সংখ্যার ছিল এক লক্ষ ৬৩ হাজার। সেই তুলনায় তদন্তকারী অফিসার না-থাকায় জমতে থাকা মামলার সংখ্যা বাড়ছে। এক পুলিশকর্তা বলেন, “অনুমোদিত পদের চেয়ে সাব-ইনস্পেক্টরের (এসআই) সংখ্যা এই মুহূর্তে ১৬০০ কম। মহিলা সাব-ইনস্পেক্টরের সংখ্যা তো হাতে গোনা। গোটা রাজ্যে মাত্র ৯২ জন মহিলা তদন্তকারী অফিসার আছেন।” এর ফলে নতুন মহিলা থানা তৈরি তো দূরের কথা, সব থানায় মহিলা পুলিশেরও সংস্থান করা যাচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা জানান, এসআই-দের উপরে মামলার চাপ কমাতে ২০১০ সালে প্রশাসনিক নির্দেশ জারি করে অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইনস্পেক্টরদেরও (এএসআই) তদন্তের ক্ষমতা দিয়েছিল তৎকালীন বাম সরকার। কিন্তু অষ্টম শ্রেণি পাশ অধিকাংশ এএসআই-কে ওই দায়িত্ব দিতে চাইছেন না ওসি-রা। ফলে সমস্যা রয়েছে সেই তিমিরেই।
তা হলে উপায়? এক পুলিশকর্তা বলেন, অর্থ দফতর সম্প্রতি ৪০০ জন এসআই নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের মাধ্যমে ওই নিয়োগ হবে। কিন্তু এত কম এসআই দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে পুলিশকর্তারাই। তাঁরা বলছেন, এখনই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করলেও প্রশিক্ষণ শেষ করে আগামী বছরের সেপ্টেম্বরের আগে ওই এসআই-দের থানায় পাঠানো অসম্ভব। তত দিনে ১৫০ জন অবসর নেবেন। ফলে শূন্য পদের সংখ্যা কার্যত আগের মতোই থেকে যাবে।
তা হলে সিভিক পুলিশ নিয়োগে সরকার এত উৎসাহী কেন? রাজ্য প্রশাসনের একাংশের মতে, মূলত পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিকে তাকিয়েই এই সিদ্ধান্ত। জেলা পুলিশকে মৌখিক ভাবে বলে দেওয়া হয়েছে, নির্বাচনের আগেই বাছাই পর্ব সেরে ফেলতে হবে। তার তালিকা পাঠাতে হবে মহাকরণে। সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দৈনিক পারিশ্রমিক হিসেবে ১৪১ টাকা ৮৫ পয়সা দেওয়া হবে সিভিক পুলিশের কর্মীদের। ১০ দিনের প্রশিক্ষণ হবে তাঁদের। তখনও ওই টাকাই মিলবে। তবে প্রশিক্ষণের পরেই যে তাঁরা কাজ পাবেন, এমন নিশ্চয়তা দিচ্ছে না সরকার। বিজ্ঞপ্তি বলছে, প্রয়োজনমতো যান-শাসন, উৎসব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ওই বাহিনীকে ব্যবহার করবে জেলা প্রশাসন।
অর্থাৎ প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজের আশায় বসে থাকতে হবে। প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য, পঞ্চায়েত ভোটের আগে কাজ নয়, কাজের কল ঝুলিয়ে রাখা হল বেকার যুবকদের সামনে। |