এ যেন এক অন্য পাঠশালা।
থানার সামনে গাছতলায় চেয়ারে ‘গুরুমশাই’ বড়বাবু-মেজবাবু। সামনে গোল হয়ে বসে এক দঙ্গল কিশোরী। কথায় বলে, ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে আটান্ন’। সেই খাকি ‘বাঘের’ ডেরাতেই মেয়েদের এনে সাহস জোগানোর কাজ শুরু হয়েছে পুরুলিয়ায়।
সাহস জোগানোর গোড়ার কথা বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করা। অতএব গুরুমশাই, কাশীপুর থানার ওসি অরিন্দম মুখোপাধ্যায় ছাত্রীদের কাছে জানতে চাইলেন, “উইমেন ট্র্যাফিকিং বোঝো?” সমস্বরে জবাব, “না।’’ “শোনো, কোনও মেয়েকে ভুল বুঝিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হল ‘ট্র্যাফিকিং’। এই দুষ্টচক্র থেকে সাবধান থাকতে হবে,” ওসি বুঝিয়ে চলেন।
একটি মেয়ে বলে ওঠে, “স্যার, আমাদের পাশের গ্রাম থেকেও একটি মেয়েকে ঠিক এই ভাবেই এক জন নিয়ে গিয়েছিল!” গুরুমশাই হাঁ-হাঁ করে ওঠেন, “আহা, ওটা ‘ট্র্যাফিকিং’ নয়! ওটা আমি জানি। ১৮ বছরের কমবয়সী ওই মেয়েটি এক জনের সঙ্গে পালিয়েছিল। সেটাও আইনত ঠিক নয়। মেয়েটির বাবা থানায় অভিযোগ করেছিলেন। সেই মেয়ে এখন হোমে।” |
থানার মেজবাবু দেবীদাস সিংহরায় চোখ গোল-গোল করে সাবধান করেন, “কেউ দামি জিনিস দেওয়ার বা আরও ভাল থাকার লোভ দেখিয়ে কোথাও নিয়ে যেতে চাইলে, একদম ফাঁদে পা দেবে না! সোজা থানায় এসে বলবে।” মিহি গলায় প্রশ্ন উড়ে আসে, “সে সময়ে যদি ঘরে বাবা না থাকে? কার সঙ্গে আসব?” ওসি হেঁকে ওঠেন, “বাবা ফেরার অপেক্ষায় বসে থেকো না। আমাদের ফোন নম্বর লিখে নাও। সোজা ফোন করে দেবে।”
কোলে রাখা ছোট্ট খাতায় খসখস করে নম্বর টুকে নেয় মেয়ের দল। তার পরে মুখ তুলেই ফের প্রশ্ন, “আচ্ছা, রাস্তায় যদি অচেনা কোনও ছেলে খারাপ কিছু বলে?” মেজোবাবুর জলদি জবাব, “আরে! থানার ফোন নম্বরটা মুখস্ত রাখবে। কোনও বুথ থেকে কিংবা কারও মোবাইল থেকে ফোন করে খবর দেবে।”
বাধ্য ছাত্রীর মতো মাথা নাড়ল কালিয়াদা, সুরাইডি, জিয়াড়া, জীবনপুরের মতো বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা পদ্মাবতী মাণ্ডি, তিলকা হাঁসদা, মমতা সোরেন, বাসন্তী মুর্মু, রেশমা খাতুনরা। ‘রাজীব গাঁধী স্কিম ফর এমপাওয়ারমেন্ট অফ অ্যাডোলেসেন্ট গালর্স’-এর আওতায় ‘সবলা’ কর্মসূচিতে তাদের জড়ো করে এনেছেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা। পুরুলিয়ার ১৩টি ব্লকে সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এই কাজ শুরু করেছে।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর সঞ্জয় দেওঘরিয়া বলেন, “ঘরে-বাইরে সমস্যায় পড়লে ১১-১৮ বছরের মেয়েদের কী করা উচিত, তা শেখানো হচ্ছে।” জেলার পুলিশ সুপার সি সুধাকর মনে করছেন, এটা যথেষ্ট সদর্থক চেষ্টা। তাঁর কথায়, “পুলিশের কাছে মেয়েরা নানা খুঁটিনাটি জানতে চায়। এতে আখেরে ভাল হবে।”
ওই মেয়েদের যাঁরা থানায় এনেছিলেন, সেই অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী যশোদা হাঁসদা বা মলিরানি মণ্ডলেরাও ক্লাসের এক পাশে বসে শুনে নিয়েছিলেন পুলিশের পাঠ। মেয়ের দল যখন হাসিমুখে বাড়ি ফিরছে, তাঁরাও হাল্কা মনে ঘরের পথ ধরেছেন। এক জন বলেন, “আমরাও এই প্রথম থানায় এলাম। কিন্তু এখন আর ভয় লাগছে না। গোলমেলে কিছু ঘটলেই পুলিশদাদাদের ফোন করে দেব।” |