হাঁকারি পাড়িলে বনে ‘তাঁর’ কথা পড়ে গো মনে
চার-খুঁটির উপরে রঙচটা নীলচে ত্রিপল। কোনাকুনি টাঙানো দু’টি আধ ময়লা হ্যাজাক ঘিরে অগুন্তি রাত-পতঙ্গের ভিড়। পালা বসেছে ঝড়খালির স্কুল মাঠে। চাদর-কাঁথায় মুড়িসুড়ি দেওয়া ভিড়টার এক কোণায় শাড়ির খুঁটে চোখ মোছেন সাবিত্রী মণ্ডল।
এই চৈত্রে তিন বছর হবে। সাবিত্রী বলেন, “অমন জুয়ান মানুষটার দেহটারে যখন নিয়ে এল, তখন ন্যাতা হয়ি গ্যাছে। বাঘে ছুঁলি আর কিস্যু করবার থাকে না গো!” বিদ্যা নদীর খোল থেকে উড়ে আসা হাওয়ার মতোই গভীর এক শ্বাস তাঁর গলায়। ঘাড়ে দু’টো ফুটো আর ঈষৎ খোলা চোখ, পনেরো বছর ঘর করা স্বামী প্রভাত মণ্ডলের সেই মৃত-মুখটাই মনে আছে সাবিত্রীর।
উষা কাটুলিয়ার তো এখনও মনে হয়, এই বুঝি উঠোনে দাঁড়িয়ে মানুষটা হাঁক পাড়বে, ‘কই গো পাত পাড়ো, খাওয়াদাওয়া করেই ডিঙা ভাসাইতে হইব’। সেই দুপুরে ডিঙি নৌকায় যেন ভেসে গিয়েছিল তাঁর তিন-মাথার সংসারটাই! চামটার জঙ্গলে তাঁর সংগ্রহ করা মধুর চাকটা কলা পাতা মুড়ে গ্রামে ফিরিয়ে এনেছিলেন সঙ্গীরা। প্রশান্ত কাটুলিয়ার আর ঘরে ফেরা হয়নি। টেনে-হিঁচড়ে ‘দক্ষিণ রায়’ তাঁকে বাদাবনের এমন গহিনে নিয়ে গিয়েছিল যে দেহ আর উদ্ধার করা যায়নি। |
ঝড়খাড়ির স্বজনহারারা। দেবস্মিতা চক্রবর্তীর তোলা ছবি। |
আর, বন দফতরের খাতায় ‘টাইগার-কিল’ হয়ে গিয়েছেন বাসুদেব রায়। আগামী বর্ষায় তেরো বছর হবে। কিন্তু নদী উজিয়ে, হেড়োভাঙার জঙ্গলে ‘তিনি’ হাঁকাড়ি পাড়লে এখনও হু-হু করে তাঁর মনে পড়ে যায় সেই সব দিন-রাত্রি। মালতী মণ্ডল বলেন, “উনি সব সময় বলতেন ‘বাঘে আমারে ছোঁবে না।’ তা বললি কী হয়... সেই দক্ষিণ রায়েই নিল তাঁরে।” কপালে দু’বার হাত ঠেকান প্রৌঢ়া।
হেড়োভাঙা, চামটা, দোবাঁকির জঙ্গলে ‘বাঘে নিয়েছে’ তাঁদের স্বামী-স্বজন। হারানো মানুষগুলোর মৃত্যু-দিনে মাটির দাওয়ায়, কুপির আলোয়, সস্তা ধূপে স্বজনের স্মরণ ছাড়া তাঁদের আর সান্ত্বনা কী? আছে। আন্তর্জাতিক মহিলা দিবসে শোক ভুলে প্রকৃতির ভারসাম্য বাঁচিয়ে রাখতে ঝড়খালির ওই মহিলাদের বাদাবন বাঁচানোর প্রয়াসকেই ‘সেরা লড়াই’ মনে করছে একটি জার্মান টেলিভিশন সংস্থা। তাঁদের উপরে স্বল্পদৈর্ঘ্যের একটি ছবিও আজ, সম্প্রচার করছে সংস্থাটি।
সুষমা হালদার সেই স্বজনহারা মহিলাদের এক জন। ষোলো বছর আগে তাঁর সদ্য তরুণ ছেলেকে সূর্যমণির জঙ্গলে বাঘে টেনে নিয়ে যাওয়ার শোকে আত্মঘাতী হয়েছিলেন পুত্রবধূও। দুই নাবালক নাতি-নাতনিকে একাই গড়ে পিঠে তুলছেন বৃদ্ধা। তিনি বলেন, “তাঁরা নেই, আমরা তো আছি। নাতি-নাতনি আছে। আমাদের বাদা জঙ্গল, সোঁদরবন তো রয়েছে। তাকে বাঁচিয়ে রাখতে তাই বছরভর হেতাল, বায়ান, গরানের চারা লাগাই আমরা।”
আয়লা, নার্গিসের মতো সমুদ্র থেকে ক্রমান্বয়ে উড়ে আসা উত্তাল সাইক্লোনে কত বার ছারখার হয়ে গিয়েছে তাঁদের ভিটেমাটি। তবু যেটুকু টিঁকে রয়েছে তা তো বাদাবন আছে বলেই। গত কয়েক বছরে জল-জঙ্গলের কাছে এমনটাই শিখেছেন ওঁরা। লক্ষ্মী ঢালি শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে তাই বলেন, “এই বাদাবন বাঁচলি তবেই মোরা বাঁচব। দক্ষিণ রায় বাঁচবেন। তাই বন দফতরের কাছে চারা কিনে ঝড়খালি জুড়ে গ্রামগুলোর আনাচে কানাচে বাদাবন গড়ি।”
খামখেয়ালি সমুদ্র মোহনার এই মেজাজের সঙ্গে সহাবস্থানের একমাত্র উপায়, বাদাবন রক্ষা করা। গ্রামের স্বজনহারা মানুষগুলোর মধ্যে এ বোধটা বছর কয়েক আগে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন প্রায় দৃষ্টিহীন এক যুবক, আকুল বিশ্বাস। তাঁর হাত ধরেই ঝড়খালির ত্রিদিবনগর, নতুন গ্রাম, সর্দারপাড়ার বিভিন্ন স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী আর স্ব-সহায়ক দলের এমনই ৪২ জন স্বজনহারা মহিলা গড়ে তুলেছেন ‘ঝড়খালি সবুজ বাহিনী।’ আকুল বলেন, “সমুদ্রের ঝড়-ঝাপটা থেকে সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাথমিক কাজটা করে বাদাবন। মাটির গভীরে শেকড় চালিয়ে দ্বীপগুলির মাটির ক্ষয় রোখে হেতাল, গরান সুন্দরীর মতো বাদা বনের গাছ। সেই বন না বাঁচলে সুন্দরবন যে বাঁচবে না সে কথাই ওঁদের বুঝিয়েছি এত দিন। এখন ওঁরাই গ্রামের অন্যদের সে কথা বোঝান।” দক্ষিণ রায়ের সাবেক ঠিকানা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে দুপুরের রোদ পিঠে ফেলে তাই বাদাবন গড়ে তোলেন ওঁরা।
বাঘের থাবায় প্রাণ গেলেও ওই পরিবারগুলির অধিকাংশই কিন্তু বন দফতরের ক্ষতিপূরণ পায়নি। কেন?
বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে জঙ্গলে প্রবেশাধিকার বন্ধ। তবে সুন্দরবনের অভাবী মানুষ রুজির টানে সেই সময়েও জঙ্গলে পাড়ি দেন। বন দফতরের এক কর্তা বলেন, “সেই সময়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারালে বন দফতরের দায় নেই। ক্ষতিপূরণও মেলে না। তার উপর অনেকে বৈধ পারমিট ছাড়াই জঙ্গলে গিয়ে প্রাণ হারান।”
বিদা্যধরী, মাতলা আর হেড়োভাঙা, তিন নদীর মাঝে এক চিলতে ঝড়খালি বাদাবনে সবুজ হয়ে আছে। সে বনে দক্ষিণ রায় আসে। ‘হাঁকাড়িও পাড়ে’। স্বজনের স্মৃতি নিয়ে সেই বাদাবন মৃদু কাঁপে, কাঁপতেই থাকে। |