বেয়ারিং বদলের দায় কার, শুরু হল তরজা
শুধু বিশেষজ্ঞদের একাংশই নন, উল্টোডাঙা উড়ালপুলে বেয়ারিং বসানোয় গলদের অভিযোগ তুলল সেতুর নকশাকার সংস্থা কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস-ও (সিইএস)।
উড়ালপুলটির একাংশ খসে পড়ার পরে বিশেষজ্ঞদের কারও কারও নজরে আসে, সেতুর ভার-টান সামলানোর জন্য যে আপলিফ্ট বেয়ারিং বাঁকের ভিতরের দিকে (সল্টলেকের দিকে) বসানোর কথা ছিল, সেটি আসলে বসানো হয়েছিল বাঁকের বাইরের দিকে (ভিআইপি রোডের দিকে)। বেয়ারিং বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, বাঁকের বাইরের দিকে চাপ বহনের পট পিটিএফই বেয়ারিং-ই বসানোর কথা। কিন্তু উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ায় মার্বেল বোঝাই ট্রাকের ভারে উড়ালপুলটির একাংশ খসে পড়ে। আনন্দবাজারে এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পরে এই ভুলের দায় কার, এ নিয়ে মঙ্গলবার দিনভর সংশ্লিষ্ট কর্তাদের মধ্যে চাপানউতোর চলে। ভুল কার নকশাকার সংস্থার, না নির্মাণ ও নজরদারি সংস্থার, তা নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। এর মধ্যেই মুখ খোলে নকশাকার সংস্থা সিইএস।
সিইএসের কর্ণধার সুধাংশুশেখর চক্রবর্তী মঙ্গলবার বলেন, “বেয়ারিং বসানোয় ভুল হয়েছিল বলেই উড়ালপুলের ভারসাম্য নষ্ট হয়। বাঁকের ওই অংশটা খুলে পড়ে।” প্রশাসনের কাছে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিও তিনি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “এ দেশের প্রতিটি বড় শহরে আমাদের নকশায় অনেক বড় বড় উড়ালপুল তৈরি হয়েছে। সেগুলো দিনের পর দিন কাজ করছে। কোনও দুর্ঘটনা হয়নি। কেএমডিএ নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করুন। তা হলেই বেয়ারিং বসানোর গলদ প্রকাশ্যে আসবে।” দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে অবশ্য মন্তব্যে রাজি নন উড়ালপুলের নকশাকার সিইএসের দীপঙ্কর পাল। তার দাবি, “নকশা যে ঠিক ছিল, তদন্তেই সেটা প্রমাণিত হবে।” এই বিভ্রাটের জন্য নির্মাতা সংস্থা ম্যাকিনটস বার্ন ও রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি কেএমডিএ-র দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলেছে সিইএস।
উল্টোডাঙা উড়ালপুলের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ।—নিজস্ব চিত্র
ম্যাকিনটস বার্ন-ও কিন্তু দুর্ঘটনার দায় নিতে চায়নি। তাদের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “উল্টোডাঙা উড়ালপুলের কাজে আমরা ছাড়াও আরও দু’টি সংস্থা (কেএমডিএ এবং বেঙ্গল সিইএস) জড়িত ছিল। কিন্তু শুধু আমাদেরই বলির পাঁঠা করা হচ্ছে।” নির্মাণের ক্ষেত্রে ওই সংস্থার দায়িত্ব কী ছিল? এক শীর্ষ কর্তা জানান, দায়িত্ব ছিল নকশা অনুযায়ী কাজ করা এবং নির্মাণ সামগ্রী কেনা। বছরখানেক আগে উড়ালপুলে ফাটলের একটি ঘটনায় তদন্ত কমিটি তৈরি হয়। রাজ্য নগরোন্নয়ন দফতর সূত্রের খবর, তদন্ত কমিটি নির্মাণকাজ ও মাল-মশলা নিয়ে সন্তোষজনক রিপোর্টই দিয়েছিল।
ম্যাকিনটসের দাবি, তারা হুবহু নকশা মেনেই কাজ করেছে। কিন্তু অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারদের মতে, নকশায় ত্রুটি থাকলেও নির্মাণে ভুলের দায় শুধু নকশাকারের উপরে চাপানো ঠিক নয়। জনৈক পোড়খাওয়া ইঞ্জিনিয়ারের বক্তব্য, “উড়ালপুলের নকশা বেদবাক্য নয়। অনেক সময়ে কাজ করতে গিয়ে বোঝা যায়, এ ভাবে করলে ঠিক হবে না। সেই ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগও অনেক ক্ষেত্রেই থাকে।” বেয়ারিং-বিশেষজ্ঞ তথা প্রবীণ ইঞ্জিনিয়ার অচ্যুত ঘোষের কথায়, “সাধারণত, এই কাজের প্রতিটি পর্যায়েই একাধিক উপদেষ্টা থাকেন। তা ছাড়া, একটি সংস্থা কাজ করলে অন্য কারও উপরে তদারকির (সুপারভাইজ) ভার দেওয়া থাকে। কাজটা ঠিক হচ্ছে কি না, তা পদে পদে খতিয়ে দেখেই এগোন উচিত।” বাস্তবে এই পদ্ধতি কতটা মেনে চলা হয়েছিল তা নিয়েই সংশয় রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারদের।
উড়ালপুলের নকশা তৈরির কাজে অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার অমিতাভ ঘোষালও প্রধানত উড়ালপুলটির নির্মাণের সময়ে তদারকির অভাব থাকার সম্ভাবনাকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাঁর মতে, তদারকির বড়সড় ত্রুটি ছাড়া বেয়ারিং বসানোয় ভুল চোখ এড়িয়ে যেতে পারে না। অমিতাভবাবুর কথায়, “রাজ্য সরকারের তরফে কেএমডিএ প্রকল্পটির তত্ত্বাবধানে ছিল। সরকারি ইঞ্জিনিয়ারেরা কদাচিৎ রাতে কাজের সময়ে উপস্থিত থাকেন। বেয়ারিং বসানোর ভুলটা নির্ঘাত তাঁদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল।”
নিউ ইয়র্কে দীর্ঘ দেড় দশক সেতু নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার অলোক সরকারও সরাসরি উড়ালপুলটির ‘কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট’ বা নির্মাণ-পদ্ধতিপরিচালনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আর আইআইটি-গুয়াহাটির স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক অঞ্জন দত্ত মনে করেন, এ হল উড়ালপুল নির্মাণের অ-আ-ক-খ লেখায় ভুল। তাঁর মতে, “কোথায় কোন বেয়ারিং বসানোর কথা, সেই জায়গা গুলিয়ে ফেলার এমন হাস্যকর ভুল বলে দিচ্ছে, উড়ালপুলের কাজে তদারকি (সুপারভিশন) বলে কিছু ছিল না।”
উড়ালপুলের কাজের সময়ে কেএমডিএ-র চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন আনন্দ গঙ্গোপাধ্যায়। বেয়ারিং বসানোর ক্ষেত্রে গণ্ডগোলের সম্ভাবনা তিনি খারিজ করেননি। তবে তার সম্ভাব্য কারণ নিয়ে মুখ খুলতে চাননি তিনি। তাঁর মন্তব্য, “আমার তো সার্বিক দেখভালের দায়িত্ব ছিল! নির্দিষ্ট ভুল বেরোলে, সেটা কেন হয়েছে, তা সুনির্দিষ্ট ভাবে ওই কাজের দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাই বলতে পারবেন!”
দুর্ঘটনার তদন্তে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে রাজ্য। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দুই শিক্ষক দীপঙ্কর চক্রবর্তী ও অরূপ গুহনিয়োগী মঙ্গলবারও ঘটনাস্থলে যান। তদন্তে কী উঠে আসছে, তা বলতে না-চাইলেও বেয়ারিং বসানোর ‘ভুল’-এর বিষয়টিতে যে তাঁরাও গুরুত্ব দিচ্ছেন, সেটা তাঁদের কথাতেই স্পষ্ট।
মাপা বরাদ্দের দরুণ উৎকর্ষে আপস করেই কয়েকটি নামী সংস্থাকে এড়িয়ে সরকারি সংস্থা ম্যাকিনটস বার্ন-কে উড়ালপুল নির্মাণের ভার দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। এ বার বেয়ারিং বসানোর জায়গা উল্টোপাল্টা হয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠায় নির্মাণ-পদ্ধতির মধ্যেও চূড়ান্ত অপেশাদারিত্বের ছায়া দেখছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকেই।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.