এবিজি বিদায়ের ক্ষতে প্রলেপ দিতে হলদিয়ায় শিল্প সম্মেলনের আসর বসিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কিন্তু তাতে যে শিল্পমহলের আস্থা তেমন ফেরেনি, তার প্রমাণ মিলল দ্বিতীয় হলদিয়া বন্দর নির্মাণের উদ্যোগ ঘিরে। হলদি নদীর ধারে শালুকখালিতে
নতুন বন্দর নির্মাণের কাজে আগ্রহ দেখিয়ে এগিয়ে এল না দেশ-বিদেশের কোনও সংস্থা!
১৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে হলদিয়া ডক টু’তে চারটি বার্থ নির্মাণের জন্য দরপত্র ডেকেছিলেন কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষ। তিনটি সংস্থা শর্তাবলি কিনে আগ্রহ দেখালেও শেষমেশ বিনিয়োগে রাজি হয়নি। ফলে সোমবার দরপত্রে সাড়া দেওয়ার শেষ দিন পেরিয়ে গেলেও ফাঁকা হাতে বসে থাকতে হল বন্দর-কর্তৃপক্ষকে। অথচ নাব্যতা সমস্যায় জরাজীর্ণ হলদিয়া বন্দরকে চাঙ্গা করতে শালুকখালির এই সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ (পাবলিক-প্রাইভেট-পার্টনারশিপ, সংক্ষেপে পিপিপি) প্রকল্পটিকেই পাখির চোখ করেছিলেন বন্দর-কর্তারা। পুরো ঘটনাক্রম দেখে তাঁরা হতাশ।
শুধু হলদিয়া ডক টু নয়, ডায়মন্ড হারবারে বাক্সবন্দি পণ্য খালাসের জন্য বেসরকারি উদ্যোগে যে টার্মিনাল নির্মাণে বন্দর প্রয়াসী হয়েছে, সংশয় দানা বেঁধেছে তার ভবিষ্যৎ নিয়েও। বছরে ১২ লক্ষ টন বাক্সবন্দি পণ্য খালাসের জন্য ওখানে ১৫০০ কোটি টাকা লগ্নি হওয়ার কথা। |
প্রকল্পে প্রাথমিক আগ্রহ (রিকোয়েস্ট ফর কোয়ালিফিকেশন, সংক্ষেপে আরএফকিউ) দেখানোর শেষ দিন ছিল গত ২৮ ফেব্রুয়ারি। পাঁচটি সংস্থা প্রাথমিক ভাবে আগ্রহ প্রকাশ করলেও শালুকখালির অভিজ্ঞতা বন্দর-কর্তাদের কপালে ভাঁজ ফেলেছে। শেষ পর্যন্ত এখানেও কেউ বিনিয়োগ করতে আসবে কি না, তা নিয়ে ধন্ধে পড়ে গিয়েছেন ওঁদের কেউ কেউ। শালুকখালির ঘটনা প্রসঙ্গে কলকাতা বন্দর-কর্তৃপক্ষের কী বক্তব্য? রাজ্য সরকারই বা কী বলছে?
বন্দরের চেয়ারম্যান রাজপাল সিংহ কাঁহালো মঙ্গলবার দিনভর বৈঠকে ব্যস্ত থাকায় বন্দরের বক্তব্য জানা যায়নি। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “বন্দর-কর্তৃপক্ষের কাছে খোঁজখবর না-নিয়ে কিছু বলব না।”
বন্দর-সূত্রের খবর: নাব্যতা সঙ্কটে ন্যূব্জ হলদিয়ায় এখন ২৫ হাজার টন পণ্যবাহী জাহাজ ভেড়াই মুশকিল। বন্দর সচল রাখাটা নির্ভর করে বার্ষিক পাঁচশো কোটি টাকার কেন্দ্রীয় ড্রেজিং-ভর্তুকির উপরে।
কিন্তু ভর্তুকি-ভরসায় না-থেকে বন্দর যাতে নিজের পায়ে দাঁড়ায়, সে জন্য দিল্লিও চাপ দিচ্ছে। এই অবস্থায় হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো শালুকখালিতে ৯ মিটার নাব্যতাসম্পন্ন একটি
এলাকা খুঁজে পায় বন্দর। সেখানে পিপিপি মডেলে দ্বিতীয় হলদিয়া বন্দর গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। বন্দর-কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা, শালুকখালির চারটি বার্থে বছরে ২ কোটি ৩৫ লক্ষ টন মাল খালাসের ব্যবস্থা থাকবে। মূলত, তাপ-বিদ্যুতের কয়লা ও ইস্পাত শিল্পের আকরিক লোহা নামানো হবে নতুন বন্দরে।
বস্তুতই শালুকখালিকে বন্দর বাঁচানোর একমাত্র রুপোলি রেখা হিসেবে ধরেছিলেন কর্তারা। তাঁদের আক্ষেপ, বছরে ৫ কোটি টন পণ্য খালাসে সক্ষম হলদিয়া বন্দরে গত বছর খালাসের পরিমাণ তিন কোটি টনও ছোঁয়নি। জাহাজি মহলের একাংশের মতে, নাব্যতা-সঙ্কটের পাশাপাশি বিশ্ব-বাণিজ্যের মন্দা এর বড় কারণ তো বটেই, উপরন্তু সঙ্গে জুড়েছে উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি।
আর এ হেন পরিস্থিতির পটভূমিতে, ২০১২-র এপ্রিলে শালুকখালিতে বিনিয়োগে আগ্রহীদের নিয়ে বৈঠক শুরু করেছিল বন্দর। প্রথমে ১৫টি সংস্থা আগ্রহ দেখায়। অক্টোবর নাগাদ বন্দর-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আটটি সংস্থা বৈঠকও করে যায়।
কিন্তু ততক্ষণে এবিজি-কাণ্ডের জেরে হলদিয়ার হাওয়া আরও গরম হয়ে উঠেছে।
বন্দর-সূত্রের খবর: প্রাথমিক ভাবে আগ্রহী কোনও সংস্থা আর বিনিয়োগে এগিয়ে আসছিল না। বলতে গেলে বন্দর-কর্তৃপক্ষের চাপাচাপিতে ‘বিড ডকুমেন্ট’ কেনে তিনটি সংস্থা টাটা গোষ্ঠীর টিএমআইএল, আদানি পোর্ট এবং হুন্ডাইয়ের কনসর্টিয়াম। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কেউই বিনিয়োগে আগ্রহ দেখায়নি। কেন?
সংস্থাগুলির তরফে বলা হচ্ছে, হলদিয়া ডক টু থেকে বিরাট ব্যবসার আশা নেই। তাদের দাবি, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে লৌহ আকরিক এবং কয়লা-নির্ভর শিল্পে বড় বিনিয়োগের সম্ভাবনা ক্ষীণ। কাজেই তারা আগ্রহ দেখায়নি। যদিও
জাহাজি-সূত্রের মতে, এবিজি’কে ঘিরে সম্প্রতি হলদিয়ায় যে কাণ্ড ঘটে গিয়েছে, তাতে বড় ধাক্কা খেয়েছে সম্ভাব্য লগ্নিকারীদের আস্থা।
এই মহলের বক্তব্য: আন্তর্জাতিক বাজারে মন্দাভাব কাটেনি। ফলে নতুন বিনিয়োগ এমনিতেই কমছে। তার উপরে পরিবেশ যদি সুস্থির ও শিল্প সহায়ক না হয়, সে ক্ষেত্রে লগ্নি টানা আরও কঠিন হতে বাধ্য।
এবং পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষত হলদিয়ায় তেমনই একটা ছবি শিল্প-বাণিজ্যমহলের একাংশের নজরে আসছে। এবিজি-বিদায়ের আঁচ ভাল রকম টের পাচ্ছে বন্দরও।
২ এবং ৮ নম্বর বার্থে কোনও নতুন সংস্থাকে আনা যায়নি। দু’টি সংস্থা যে শর্ত দিয়েছে, তা মানলে বন্দরের লোকসান হবে বিস্তর। মাল খালাসের অত্যাধুনিক যান্ত্রিক ব্যবস্থা না-থাকায় হলদিয়া বন্দর ফিরে গিয়েছে কোদাল-বেলচার যুগে। অতিরিক্ত পণ্যবাহী গিয়ারলেস ভেসেল আসা কার্যত থমকেই গিয়েছে।
হলদিয়ার ছবিটাকে রাজ্যের সামগ্রিক শিল্প-চিত্রের একটি প্রতীক হিসেবে ধরতেও দ্বিধা করছেন না শিল্প-বাণিজ্য কর্তাদের অনেকে। তাঁদের বক্তব্য: তোলাবাজির জুলুমে গ্রামে গ্রামে পাকা রাস্তা নির্মাণের ঠিকাদার মিলছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। গত দেড় বছরে কোনও উল্লেখযোগ্য লগ্নি-প্রস্তাব রাজ্য পায়নি। এমনকী, বেঙ্গল লিডসের আসরেও হাজির হননি বিশেষ বড় কোনও শিল্পপতি। ছিলেন না বৃহৎ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতেরাও। সামগ্রিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গের লগ্নি সহায়ক পরিবেশ সম্পর্কে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। তারই খেসারত দিতে হচ্ছে হলদিয়াকে।” মন্তব্য এক শিল্প-কর্তার। |