|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
ছাত্র ইউনিয়নের চরিত্র সংশোধন করা দরকার,
তাকে বিসর্জন দেওয়া নয় |
কোনও গণতন্ত্রই নিখুঁত নয়। আমাদের অপূর্ণ গণতন্ত্রে নানা অপূর্ণ প্রতিষ্ঠান আছে।
কলেজ ইউনিয়ন তার ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান যাতে আরও ভাল কাজ
করতে পারে, আরও মূল্যবান প্রশ্ন তুলতে পারে, সে জন্য তাদের উন্নতি সাধনের চেষ্টা
করাই
আমাদের কাজ হওয়া উচিত, প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করা নয়। অনুপ সিংহ |
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচন উপলক্ষে নানা অশান্তি এবং হিংসাত্মক ঘটনার সূত্রে একটা তর্ক উঠেছে, কলেজে ছাত্রদের ইউনিয়ন আদৌ থাকার কোনও দরকার আছে কি না, থাকলেও তার নির্বাচনের কোনও প্রয়োজন আছে কি না। শিক্ষাজগতের দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অনেকে বলেছেন, ইউনিয়নগুলি কোনও কাজের কাজ করে না, কেবল তাদের পান্ডাদের এবং তাঁদের পিছনে থাকা রাজনীতিকদের রসদ জোগাড় করে। এটা নানা ভাবে করা হয়। যেমন, কলেজে কলেজে বড় বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলি ‘স্পনসর’দের কাছে মোটা টাকা আদায়ের সুযোগ করে দেয়। কিংবা, কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই ইউনিয়নের নেতাদের ‘ফি’ দিতে বাধ্য হয়। ইউনিয়নকে সবাই ভয় পায়, এই ভয়টাই তাদের আর্থিক ও অন্যান্য প্রতিপত্তির উৎস। এরা ছাত্রদের সত্যিকারের কোনও উপকারে লাগে না। ছাত্রছাত্রীদের একটা খুব ছোট অংশই ইউনিয়নের কাজে জড়িত থাকে। শিক্ষকরাও তাদের সমঝে চলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতেই অনেকে বলছেন, ইউনিয়ন যদি বৃহত্তর স্বার্থ চরিতার্থ না-ই করে, তা হলে সেগুলি রাখার দরকার কী?
কলেজ ইউনিয়ন সম্পর্কে এই ধারণা একটা খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয়। হিংসা এবং অনাচার ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতির চরিত্রে সাধারণ ভাবেই আছে। সেই যুক্তিতে যদি কলেজ ইউনিয়ন বা ছাত্র রাজনীতি বাতিল করতে হয়, তা হলে একই যুক্তিতে দেশ থেকে সমস্ত রাজনৈতিক কাজকর্মকে নির্বাসন দিতে হয়, নির্বাচনকেও। ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রছাত্রীদের যথার্থ স্বার্থ দেখে না, এই অভিযোগের উত্তরে বলতে হয়, রাজনীতিকরাও তাঁদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেন না, বিভিন্ন সরকারও নাগরিকদের মঙ্গল সাধনের জন্য বিশেষ কিছু করে না, অন্তত বহু নাগরিক তেমনটাই মনে করেন। এই সব প্রতিষ্ঠানের যত দোষত্রুটিই থাক, তাদের বাতিল করার প্রস্তাব গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক।
আমার অবশ্য মনে হয়, ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে যাঁরা খড়্গহস্ত, তাঁরা ভারতীয় সংসদ বা অন্য বৃহত্তর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি বাতিল করতে বলবেন না। আসলে তাঁদের অভিমতের পিছনে একটা গভীরতর বিশ্বাস নিহিত আছে। সেটা এই যে, ছাত্রদের বয়স কম, তাদের কাজ লেখাপড়া করা, দলীয় রাজনীতির মধ্যে তাদের যাওয়া উচিত নয়, তার প্রয়োজনও নেই। অদ্ভুত যুক্তি। ভারতীয় রাষ্ট্র ভোটাধিকারের ন্যূনতম বয়স একুশ থেকে কমিয়ে আঠারো করে দিয়েছে অনেক দিন আগে। অর্থাৎ, রাষ্ট্র মনে করে, আঠারো বছর বয়সে দেশের সরকার নির্ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় মানসিক পরিণতি এসে যায়। সুতরাং কলেজের ছাত্রছাত্রীদের রাজনীতি করার বয়স হয়নি, এ যুক্তি অচল। |
|
মৌলিক প্রশ্ন তোলার বয়স ও পরিসর।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা। ছবি: অমিত দত্ত |
একটা প্রশ্ন উঠতে পারে। ছাত্ররা রাজনীতি করুক, কিন্তু তার জন্য কলেজে ইউনিয়ন করতে হবে কেন? কলেজটা তো পড়াশোনার জায়গা। অন্য ভাবে বললে, রাজনৈতিক কাজকর্মের একটা স্থানকালপাত্র থাকা উচিত সাধারণ নির্বাচনে ভোট দেওয়া যুক্তিসঙ্গত, কিন্তু কলেজটা রাজনীতি করার জায়গা নয়, জ্ঞানান্বেষণ এবং বিদ্যাচর্চাই ছাত্রজীবনের কাজ। এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, সমাজ বিষয়ে, ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ে যদি জানতে হয়, তবে রাজনীতিকে বাদ দিয়ে সেই জ্ঞান সম্পূর্ণ হতে পারে না। তার একটা প্রয়োগের দিকও আছে। সে জন্য রাজনীতির অনুশীলন দরকার। সঙ্কীর্ণ দলীয় রাজনীতির কথা বলছি না, বলছি বড় রাজনীতির কথা। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সেই অনুশীলনের পক্ষে বিশেষ ভাবে উপযোগী একটি পরিসর। ছাত্র ইউনিয়নের কাজকর্ম, আলোচনা, তর্কবিতর্ক, গণতান্ত্রিক নির্বাচন, এই সব কিছুর মধ্যে দিয়েই তরুণ নাগরিকরা একটা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক মানসিকতা অর্জন করতে পারে। একটা উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কলেজ ইউনিয়নের ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভিজ্ঞতাও যেমন গণতন্ত্রের শিক্ষা দেয়, তেমনই ভোটে হেরে গেলে সেই পরাজয়কে মেনে নিতে শেখাও অত্যন্ত মূল্যবান। যথার্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতির শিক্ষা একটা সম্পূর্ণ জীবনের পক্ষে খুবই জরুরি। এই ধারণার কোনও যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি নেই যে, পদার্থবিদ্যার পড়াশোনা এবং গবেষণাগারে হাতেকলমে তা নিয়ে কাজ করা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, রাজনীতির জ্ঞান এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যোগদান তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ।
অন্য দিকে, ছাত্র রাজনীতির পক্ষে একাধিক প্রত্যক্ষ যুক্তির কথা ভাবা যায়। প্রথমত, প্রচলিত ব্যবস্থায় তরুণদের কায়েমি স্বার্থ কম, তাই ছাত্রজীবনে মানুষ সচরাচর স্থিতাবস্থাকে অনেক বেশি নৈর্ব্যক্তিক সমালোচনার দৃষ্টিতে বিচার করতে পারে। তারা যে রকম মুক্ত মনে একটা উন্নততর সমাজ এবং সাহসী নতুন দুনিয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে, পোড়-খাওয়া প্রবীণ রাজনীতিকদের কাছে সেটা আশা করা যায় না। তাঁরা মনে করেন, পরিবর্তন সব সময়েই অল্প অল্প করে হওয়া উচিত, নীতি ও কার্যক্রম ধীরে ধীরে বদল করেই সেই পরিবর্তনের পথে চলা ভাল। এটাও মনে রাখা দরকার যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজেই প্রচলিত স্থিতাবস্থার একটা বড় অঙ্গ, সেখানে কায়েমি স্বার্থের প্রবল দাপট, বিস্তর টাকার কারবার, অপ্রাসঙ্গিক এবং অনমনীয় সিলেবাস, অপটু পরিকাঠামো, এবং সবচেয়ে বড় কথা, যাঁরা শিক্ষাজগৎটাকে নিয়ন্ত্রণ করেন রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, কর্পোরেট দুনিয়ার কর্তা— অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের সঙ্গে ওই জগতের কোনও সম্পর্ক নেই। সুতরাং সেখানে স্থিতাবস্থাকে প্রশ্ন করার কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কলেজ রাজনীতির মঞ্চটি ছাত্রছাত্রীদের সমকালীন নানা বিষয় ও সমস্যা সম্পর্কে জানার এবং তর্কবিতর্ক করার সুযোগ এনে দেয়। আরও বড় কথা, এই রাজনীতির কল্যাণেই তারা বিভিন্ন প্রশ্নে নিজস্ব অবস্থান নিতে পারে। যুক্তিশীল আলোচনা এবং বিতর্কের মধ্য দিয়ে অনেক সময়েই মানুষ নিজের অবস্থান বদলায়, এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি আমাদের চেতনাকে সমৃদ্ধ ও গভীরতর করে। তরুণতরুণীরা প্রচলিত ব্যবস্থা ও ধ্যানধারণা সম্পর্কে যে ধরনের মৌলিক প্রশ্ন তোলে, গণতান্ত্রিক রাজনীতির বৃহত্তর পরিসরে সাধারণত তেমন প্রশ্নকে উৎসাহ দেওয়া হয় না।
এখানে একটা কথা বিশেষ ভাবে বলা দরকার। প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সচরাচর দেখা যায়, যতক্ষণ সেই ব্যবস্থার মূল কাঠামোটাকে মেনে নেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ সমালোচনায় কোনও সমস্যা নেই, কিন্তু যখন সেই মূল কাঠামোটা নিয়েই প্রশ্ন তোলা হয়, তখন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আর তা সহ্য করে না। অর্থাৎ, গণতন্ত্র সমালোচনার অধিকার দেয় বটে, কিন্তু কত দূর অবধি সমালোচনা করা যাবে তার একটা সীমা বেঁধে দেয়। তার বাইরে গেলে, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূল নীতি বা ধারণাগুলিকে চ্যালেঞ্জ জানালে অনেক সময়েই রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন নেমে আসে, পরিণাম হয় হিংসাত্মক। উনিশশো ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলন সমাজ এবং অর্থনীতির কাঠামো সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক প্রশ্ন তুলেছিল, কিন্তু বিভিন্ন দেশে সমাজ ও রাষ্ট্রের নিয়ামকরা তাতে বিচলিত হয়ে আন্দোলন দমন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ষাট-সত্তরের দশকে আমাদের দেশে নকশাল আন্দোলন যে সব প্রশ্ন তুলেছিল, সেগুলি এখনও প্রাসঙ্গিক, তাদের সদুত্তর আজও মেলেনি।
এক দিকে ছাত্রদের জীবন, অন্য দিকে মানবজাতির জীবন দুই বিষয়েই খোলামেলা আলোচনা এবং বিতর্কের পরিসর তৈরি করাই কলেজ ইউনিয়নগুলির কাজ হওয়া উচিত, নিজেদের কাজকর্মে এই দিকে জোর দেওয়া তাদের কর্তব্য। তরুণ নাগরিকরা ভবিষ্যতে যে জগতে বাস করবে, পরবর্তী জীবনে যে দুনিয়ায় সফল হওয়ার আশা তারা পোষণ করে, তার সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা তৈরি করার সুযোগ এনে দিতে পারে কলেজ রাজনীতি। বাস্তবে অনেক কলেজেই এ সুযোগ মেলে না, কিন্তু অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই আবার তা কমবেশি মেলেও। এবং মানসিক চিন্তা ও চেতনার প্রসার ঘটানোর উপযোগী এমন পরিবেশ সৃষ্টির সম্ভাবনা সব সময়েই আছে। সেই সম্ভাবনাটিকে ভুলে যাওয়া বা তুচ্ছ করা উচিত নয়। এটা ঠিকই যে, কলেজ রাজনীতি অনেক সময়েই অর্থহীন হিংসা এবং সুবিধাবাদী আচরণকে লালন করে। গুন্ডামি, মারামারি, দুর্নীত— এ-সব বন্ধ করা নিশ্চয়ই জরুরি, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে নোংরা জলের সঙ্গে শিশুটিকেও বিসর্জন দিতে চাইলে ভুল হবে।
কোনও গণতন্ত্রই নিখুঁত নয়। আমাদের অপূর্ণ গণতন্ত্রে নানা অপূর্ণ প্রতিষ্ঠান আছে। কলেজ ইউনিয়ন তার ব্যতিক্রম নয়। তাদের উন্নত করা দরকার, তারা যাতে অনেক ভাল কাজ করতে পারে সে জন্য চেষ্টা করা দরকার। গণতন্ত্রের কমর্ক্ষমতা বাড়ানোর উপায় কী, আলোচনা এবং বিতর্ক হওয়া দরকার সেই বিষয়েই। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান যাতে ভাল কাজ করতে পারে, মূল্যবান প্রশ্ন তুলতে পারে, সে ব্যাপারে তাদের উৎসাহী ও সমর্থ করে তোলাটাই আমাদের কাজ, প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করা নয়।
|
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট, কলকাতা’য় অর্থনীতির শিক্ষক |
|
|
|
|
|