গাড়ির ওজন ২৮ টন। গতি ৪০ কিলোমিটার। বাঁকের মুখে এইটুকুই সহ্য হয়নি। ভেঙে পড়েছে উল্টোডাঙা উড়ালপুল। তা হলে শহরের নতুন মেট্রো প্রকল্পগুলিতে কী হবে? সেখানে তো বাঁকের পরিমাণ অনেক বেশি। আর সেই সব বাঁকের উপর দিয়ে যে ট্রেন যাবে, তার ওজন ৩৬০ টন। সর্বোচ্চ গতিবেগ দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রাকটির দ্বিগুণ, ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার।
প্রশ্ন উঠেছে, উল্টোডাঙার উড়ালপুলের মতো বিপদের আশঙ্কা নিয়েই কি ইস্ট-ওয়েস্ট, জোকা-বিবাদী বাগ এবং বিমানবন্দর-নিউ গড়িয়া মেট্রোয় সওয়ার হতে হবে যাত্রীদের?
মেট্রো রেলের কর্তারা অবশ্য এই আশঙ্কাকে আমল দিচ্ছেন না। মেট্রো রেলের বিভিন্ন প্রকল্পে অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ করেছেন কিশলয় গঙ্গোপাধ্যায়। বর্তমানে তিনি ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর তদারককারী সংস্থা কেএমআরসি-র চিফ ইঞ্জিনিয়ার। কিশলয়বাবু বলেন, “এর জন্য পরিকল্পনা, নকশা তৈরি এবং রূপায়ণের বিভিন্ন স্তরে সব রকম সতর্কতা নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি বাঁকে বিপদের আশঙ্কা এড়াতে কোথায়, কী রকম সতর্কতা নিতে হবে, সে নিয়ে রেল মন্ত্রকের নির্দিষ্ট হিসেব আছে।” উল্টোডাঙার উড়ালপুলের দুর্ঘটনার পরে কি মেট্রোর নকশা এবং নির্মাণে বাড়তি সতর্কতা নিচ্ছেন মেট্রো রেলের প্রযুক্তিবিদেরা? কিশলয়বাবুর জবাব, “না। রেলের প্রযুক্তি-নিরাপত্তার মাপকাঠিগুলো যথেষ্ট ভাল। কমিশনার অফ সেফটি এর উপর কড়া নজর রাখেন। তাই ভয়ের কিছু নেই।” |
সল্টলেকে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোয় রয়েছে এ রকমই বাঁক। শৌভিক দে-র তোলা ছবি। |
কী রকম সতর্কতা নেওয়া হচ্ছে?
মেট্রো কর্তারা জানিয়েছেন: • উড়ালপথের কাজ শেষ হওয়ার পর স্তম্ভ, বেয়ারিং ইত্যাদি ভাল ভাবে পরীক্ষা করবে নির্মাতা সংস্থা।
• বাঁকে ‘সুপার এলিভেশন’ অর্থাৎ উড়ালপথের ঢাল থাকবে অন্তত ৬ ইঞ্চি। ফলে, ট্রেনের গতির জন্য তৈরি হওয়া ‘সেন্ট্রিফিউগল ফোর্স’ বা কেন্দ্রাতিগ বল উড়ালপথের উপর প্রভাব ফেলবে না। ট্রেনের লাইনচ্যুত হওয়ার আশঙ্কাও কমে যাবে। • বাঁকের জায়গায় ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি হবে ঘণ্টায় ৩০ কিমি। • রাখা হবে ‘ডিরেলমেন্ট গার্ড’ বা ট্রেনটি ধরে রাখার জন্য দু’টি লাইনের মাঝে আরও দু’টি লাইন। যাতে দুর্ঘটনা ঘটলেও ট্রেন নীচে না পড়ে যায়।
কোন মেট্রো পথে কতগুলি বিপজ্জনক বাঁক থাকছে? প্রথমে ধরা যাক ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর কথা। মেট্রো কর্তারা জানিয়েছেন, হাওড়া থেকে সল্টলেক ১৪.৫৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মেট্রোপথের ৫.৭৪ কিলোমিটার মাটির উপরে। সেক্টর ফাইভ থেকে বেলেঘাটা সুভাষ সরোবর পর্যন্ত এই অংশে থাকছে আটটি বাঁক। কলকাতা মেট্রো রেল নিগম (কেএমআরসি) সূত্রের খবর, এর মধ্যে ছ’টি জায়গার বাঁক বিপজ্জনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই বাঁকগুলির উল্টোডাঙা উড়ালপুলের থেকে অনেক বেশি দীর্ঘ। জায়গাগুলো হল:
• কেষ্টপুরের পাশে
• ইএম বাইপাসে করুণাময়ীয়ের দিকে
• সেন্ট্রাল পার্কের উত্তর দিকে বিকাশ ভবনের দু’পাশে দু’টি
• সিটি সেন্টার এবং বাইপাসের সংযোগস্থলে এবং
• বাইপাস থেকে নারকেলডাঙায় ঢোকার পথে। ট্রেন চলবে মাটি থেকে প্রায় ১০ মিটার অর্থাৎ অন্তত তিন তলা উচ্চতার উড়ালপথ দিয়ে। প্রতিটি ট্রেনে থাকবে গড়ে ছ’টি কামরা। প্রতিটি কামরার যাত্রী-সহ গড় ওজন ৬০ টন।
জোকা-বিবাদী বাগ মেট্রোর প্রথম দফার কাজ হচ্ছে জোকা-মাঝেরহাটের ৭ কিলোমিটার অংশে। এই প্রকল্পের নকশা তৈরি করেছে রেল বিকাশ নিগম লিমিটেড। সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার বি এন দে বলেন, “ডায়মন্ড হারবার রোড যে ভাবে এঁকেবেঁকে গিয়েছে, প্রস্তাবিত উড়ালপথেও সে রকম বেশ কয়েকটি বাঁক থাকবে। কোনওটাই বিপজ্জনক নয়। গুরুত্বপূর্ণ বাঁকটি থাকছে প্রান্তিক স্টেশন জোকা ও বাঁকড়াহাটের ডিপোর মাঝে। ব্যাসার্ধ ২০০ মিটার।” তিনি বলেন, এটাই রেল মন্ত্রকের অনুমোদিত বাঁকের সর্বোচ্চ ব্যাসার্ধ। কিন্তু ঝুঁকি নিয়ে এতটা বাঁক কেন রাখা হল? বি এন দে-র উত্তর, “এই অংশের ট্রেনে যাত্রী থাকবে না। তা ছাড়া, বাঁক কমানোর মতো যথেষ্ট জমি ওখানে ছিল না।”
নিউ গড়িয়া থেকে দমদম বিমানবন্দরের ৩২ কিলোমিটার প্রস্তাবিত মেট্রোয় কমবেশি বাঁক থাকছে অন্তত ৩০টি। প্রকল্পের অন্যতম দায়িত্বপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার এ কে সিংহ বলেন, “ভিআইপি বাজার থেকে নিক্কো পার্ক শুধু এইটুকু অংশেই থাকছে সাত-সাতটি বাঁক।” তবে, এই সব বাঁকে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণের সব রকম ব্যবস্থাই রাখা হবে বলে জানান তিনি। |