বাঁধা খরচে কাজ করাতে হলে গুণগত মানের সঙ্গে আপসের সম্ভাবনা একটা থেকেই যায়। তবু বরাদ্দের চক্করে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পকে হামেশা সেই ঝুঁকির পথেই হাঁটতে হচ্ছে বলে নানা সময়ে নানা মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে। সঙ্গে উঠেছে প্রশ্ন কোন ব্যাপারটাকে সরকারের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত? নিক্তি-মাপা টাকায় কাজ সেরে ফেলা, নাকি কাজের মান সুনিশ্চিত করা?
রবিবার ভোরে উল্টোডাঙা উড়ালপুলের একাংশ ধসে যাওয়ার পরে সেই পুরনো প্রশ্নই ফের প্রকট হয়ে উঠেছে। শিল্পমহলের একাংশের দাবি: সরকারি প্রকল্প রূপায়ণের জন্য আগাম যে টাকা বেঁধে দেওয়া হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথম সারির নামী সংস্থা ওই টাকায় বরাত নিতে আগ্রহী হয় না। কারণ, তা দিয়ে গুণগত মান বজায় রাখা যায় না। তখন তুলনায় ‘পিছিয়ে থাকা’ সংস্থাকে প্রকল্প নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। উল্টোডাঙা উড়ালপুলের ক্ষেত্রে যেমন দেওয়া হয়েছিল সরকারি সংস্থা ম্যাকিনটস বার্ন-কে।
এবং এতেই বিপর্যয়ের বীজ রোপিত হয়ে থাকতে বলে মনে করছে শিল্প ও সরকারি মহলের একাংশ। তাদের মতে, বরাদ্দ মেপে কাজ করতে গিয়ে প্রকল্পটির গুণগত ও নিরাপত্তাজনিত মান সর্বক্ষেত্রে বজায় রাখা গিয়েছিল কি না, সে সংশয় জাগা স্বাভাবিক। বিশেষত যেখানে এই ধরনের সাধারণ সংস্থার পক্ষে প্রথম সারির পেশাদার নির্মাণসংস্থার মতো ‘নিজস্ব টিম’ প্রকল্পস্থলে মোতায়েন করা সব সময়ে সম্ভব হয় না। বস্তুত বহু ক্ষেত্রে তারা পুরো কাজটাই করায় অন্য ঠিকাদারদের দিয়ে। ফলে নির্মাতার নিজস্ব নজরদারিতে ঘাটতিরও সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে না সরকারি কর্তাদের
এই মহল।
রাজ্য নগরোন্নয়ন দফতর সূত্রের খবর: উল্টোডাঙা উড়ালপুল তৈরির জন্য এক প্রথম সারির বেসরকারি সংস্থা ৯২ কোটি টাকা চেয়েছিল। অথচ জেএনএনইউআরএমের আওতাধীন প্রকল্পটির রূপায়ণ খাতে বরাদ্দ হয়েছিল ৬৮ কোটি। ফলে তাদের দিয়ে কাজ করানো যায়নি। আর এক বেসরকারি সংস্থা ৬৮ কোটিতে রাজি হয়। কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতায় তখনই তাদের বরাত দেওয়া যায়নি। পরে যখন বরাতের তোড়জোড় শুরু হল, তত দিনে সংস্থাটি দর বাড়িয়ে দিয়েছে, প্রকল্প-ব্যয়বৃদ্ধির যুক্তিতে।
আর তখনই ম্যাকিনটসের আগমন। ৬৮ কোটিতে কাজ করতে তাদের আপত্তি ছিল না। অগত্যা তড়িঘড়ি তাদের হাতেই প্রকল্প নির্মাণের ভার দেওয়া হয়। “উড়ালপুল তৈরির টাকা চলে এসেছিল। কাজ তাড়াতাড়ি শুরু করতে হতো। কিন্তু ওই বেঁধে দেওয়া টাকায় কাজ করতে অন্যরা রাজি হয়নি। শেষে ম্যাকিনটস বার্ন রাজি হয়। সরকারি সংস্থা হিসেবে, দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব বিচার না-করেই তাদের বরাত দেওয়া হয়” আক্ষেপ এক কর্তার। ম্যাকিনটস-সূত্রের খবর: উড়ালপুলটি সম্পূর্ণ করতে তাদের আরও প্রায় চার কোটি টাকা বাড়তি খরচ হয়েছে। এ পর্যন্ত যার সিকি ভাগ সরকারের থেকে আদায় করতে পেরেছে সংস্থাটি। |
তুল্য-মূল্য |
ক্ষেত্র |
নামী সংস্থা |
ম্যাকিনটস |
পরিকাঠামো |
উন্নত |
পিছিয়ে |
আরঅ্যান্ডডি |
আছে |
নেই |
আর্থিক ক্ষমতা |
যথেষ্ট |
মামুলি |
দক্ষ মানবসম্পদ |
পর্যাপ্ত |
ঘাটতি |
সরকারি হস্তক্ষেপ |
নেই |
থাকে |
|
কিন্তু নামী বেসরকারি সংস্থা যে টাকায় কাজ করতে রাজি হল না, ম্যাকিনটস কেন তাতে এগিয়ে এল?
সংস্থার এক কর্তার ব্যাখ্যা, “আমাদের আর্থিক অবস্থা এত মজবুত নয় যে, বরাত হাতছাড়া করার বিলাসিতা দেখাতে পারি। কোনও কাজ ফিরিয়ে দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বড় সংস্থাগুলো দিতে পারে। কারণ, ওদের কাজের অভাব নেই।”
অর্থাৎ, আয়ের তাগিদেই বাঁধা টাকায় কাজ করতে এই ধরনের সংস্থাগুলো কার্যত বাধ্য হয় বলে সরকারি কর্তাদের অনেকের অভিমত। শুধু তা-ই নয়, নির্মাণশিল্পের সঙ্গে যুক্ত অনেকের অনুযোগ, ম্যাকিনটসের মতো সরকারি অধীনস্থ সংস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অবকাশ থাকে। সরকার ইচ্ছে করলে তাদের বিলও বাকি রাখতে পারে, প্রথম সারির সংস্থার ক্ষেত্রে যা করা কঠিন।
নির্মাণশিল্প-বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য: নামী সংস্থা উন্নতমানের কাজ করে বলেই গ্রাহকদের থেকে বাড়তি টাকা (প্রিমিয়াম) দাবি করতে পারে। তুলনায় সরকারি সংস্থার কাজ অনেকটা গয়ংগচ্ছ। অনেক ক্ষেত্রে মানের ব্যাপারেও আপস হতে পারে, বড় বেসরকারি সংস্থা যা কখনওই করবে না। কারণ, কোনও বিপদ হলে সংস্থার সুনাম ধাক্কা খাবে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “উল্টোডাঙার ঘটনায় কোনও বেসরকারি সংস্থার নাম জড়িয়ে গেলে বা দোষী প্রমাণিত হলে, বিশ্বজুড়ে কালো তালিকাভুক্ত হয়ে যেতে পারে। তখন ওরা কোনও কাজ তো পাবেই না, উল্টে চালু কাজও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সরকারি সংস্থার এই বিপদ নেই।”
এই ‘নিশ্চয়তা’ই কিছু ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতার ঘাটতি ডেকে আনতে পারে বলে আশঙ্কা নির্মানশিল্প বিশেষজ্ঞদের একাংশের। এঁদের মতে, দুই ধরনের সংস্থায় কাজের ফারাকও চোখে পড়ার মতো। কী রকম?
শিল্পমহলের একাংশ জানাচ্ছেন, প্রথম সারির নির্মাণসংস্থাগুলির নিজস্ব গবেষণা ও উন্নয়ন (রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) বিভাগ থাকে। নিত্য-নতুন প্রযুক্তি ও নক্শা নিয়ে কাজ চলে সেখানে। ফলে তাদের পেশাদারিত্ব দিন দিন বাড়ে। এক শিল্প-কর্তার কথায়, “তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে বিদেশের মাটিতে কোনও সেতুর নক্শা এ দেশের অফিসে বসেই তৈরি করা হচ্ছে।” অন্য দিকে ম্যাকিনটসের মতো সংস্থাকে নক্শার জন্য নির্ভর করতে হয় সরকার-নিযুক্ত কোনও পরামর্শদাতা সংস্থা কিংবা সরকারি ইঞ্জিনিয়ারদের উপরে। এক সরকারি কর্তার দাবি, “উল্টোডাঙার উড়ালপুলের ভেঙে পড়া বাঁকের অংশটি নিয়ে ম্যাকিনটসের কর্তাদের আপত্তি ছিল। যে কারণে কিছু দিন কাজ বন্ধও হয়ে থাকে।” কিন্তু রাজনৈতিক কারণেই ওই আপত্তি ধোপে টেকেনি বলে অভিযোগ।
নির্মাণশিল্প মহলের একাংশ বলছেন, আধুনিক নির্মাণে সময় মেনে প্রকল্প শেষ করে ফেলা যেমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তেমন কী ধরনের উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে, সে দিকেও বিশেষ নজর রাখা জরুরি। উল্টোডাঙা উড়ালপুলে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের কোনও অভিযোগ অবশ্য এখনও ওঠেনি। বরং ম্যাকিনটস বার্নের জেনারেল ম্যানেজার শম্ভু বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “এখানে দেশের প্রথম সারির সংস্থার মালপত্র ব্যবহার করা হয়েছে। উড়ালপুলে ফাটল নিয়ে তদন্ত কমিটিও নিম্নমানের মালপত্রের প্রমাণ পায়নি।” তবে বড় বেসরকারি সংস্থার মতো ম্যাকিনটসের যে নিজস্ব রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগ নেই, তা শম্ভুবাবু স্বীকার করেছেন। যদিও তাঁর দাবি, “পরিকাঠামোয় আমরা বড় সংস্থার চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও পেশাদারিত্বে খামতি নেই। না-হলে এত দিন টিকতে পারতাম না।” সরকারি কর্তাদের একাংশের পাল্টা দাবি সরকারি বদান্যতা না-থাকলে ম্যাকিনটস প্রতিযোগিতার বাজারে হারিয়ে যেত। যা শুনে শম্ভুবাবুর মন্তব্য, “সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পাই না। প্রকল্প থেকে আয় করেই কর্মীদের বেতন দিতে হয়।”
এই তরজার পাশাপাশি উঠে এসেছে মানবসম্পদের দিকটাও। নির্মাণশিল্পের সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, পশ্চিমবঙ্গ-সহ অন্যান্য রাজ্যে এই ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদের আকাল চলছে। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর দিলীপ শেনয় জানাচ্ছেন, নির্মাণশিল্পে দক্ষ মানবসম্পদের অভাব তাঁদের সমীক্ষাতেও ধরা পড়েছে। “ইঞ্জিনিয়ারেরা ঠিকঠাক নক্শা বানালেও যাঁরা হাতে-কলমে কাজ করছেন, তাঁদের সামান্য ভুল অনেক প্রকল্পের অনেক বড় ক্ষতি করে দিতে পারে। পেশাদারিত্বের সঙ্গে নজরদারি চালানোর মতো সুপারভাইজারেরও অভাব,” বলেন শেনয়। তাঁর অভিমত, এই কারণেই বেসরকারি সংস্থাগুলো চড়া বেতনে দক্ষ কর্মী নিয়োগ করছে। তাই অনেক ক্ষেত্রে কাজের গুণমানেও তারা এগিয়ে থাকছে।
উল্টোডাঙার প্রকল্পে ম্যাকিনটস বার্ন যে সব ঠিকাদার সংস্থাকে দিয়ে কাজ করিয়েছিল, তাদের মানও খতিয়ে দেখা উচিত বলে অনেকের মত। শম্ভুবাবু জানাচ্ছেন, কেএমডিএ রীতিমতো পরীক্ষা নিয়ে দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ করেছিল। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন জানান, উল্টোডাঙা উড়ালপুল প্রকল্পে ম্যাকিনটস বার্নের কী ভূমিকা, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। তাঁর কথায়, “প্রকল্প নির্মাণের সময়ে কোন কোন আধিকারিক যুক্ত ছিলেন এবং ম্যাকিনটস বার্নের হাতে রক্ষণাবেক্ষণের ভার ছিল কি না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে।” |