বাঁকের উপরে বিষফোড়া বেয়ারিং-বিভ্রাট
ওলটপালটেই বিপদ, বলছেন বিশেষজ্ঞরা
বিপজ্জনক বাঁকের কথা রবিবারেই বলেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। বলেছিলেন, এর ফলে সেতুর ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। সোমবার সামনে এল নির্মাণ ক্ষেত্রে আর এক ধরনের গলদের কথা। বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারদের একাংশ এ দিন আঙুল তুলেছেন বেয়ারিং-বিভ্রাটের দিকে।
কী সেই বিভ্রাট?
ওই ইঞ্জিনিয়ারদের বক্তব্য, জায়গা বদল হয়ে গিয়েছিল বেয়ারিংয়ের। ফলে ‘পিট’-এর চাপ নিতে হয়েছে ‘আপলিফ্ট’-কে। আর ‘আপলিফ্ট’-এর টান সইতে হয়েছে ‘পিট’-কে।
কিন্তু এই ‘পিট’ আর ‘আপলিফ্ট’ কী? বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এই দু’টি হচ্ছে দু’ধরনের বেয়ারিং। সামগ্রিক ভাবে সেতুর ওজন ও যানবাহনের চাপ সহ্য করে ভারসাম্য বজায় রাখাই বেয়ারিংয়ের কাজ। কিন্তু প্রকার ভেদে এদের কাজের ধরন আলাদা। ‘পিট পিটিএফই’ বেয়ারিংয়ের কাজ হল ভার রাখা। এটা লাগানো হয় সেতুর বাঁকের বাইরের দিকে। আর ‘আপলিফ্ট’ বেয়ারিংয়ের কাজ ভারের সঙ্গে টান সহ্য করাও। এটা লাগানো হয় সেতুর বাঁকের ভিতরের দিকে। উল্টোডাঙা উড়ালপুলের খুলে-পড়া বাঁকা অংশটির নীচের লোহার পাতে চারটি পায়ার মতো আটকে ছিল চার-চারটি বেয়ারিং। “দেখা যাচ্ছে, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চেপেছে এখানে। বাইরের দিকের (অর্থাৎ ভিআইপি থেকে বাইপাসের দিকে যাওয়ার সময় ডান দিকের) বেয়ারিং দু’টি লাগানো হয়েছে ভিতরের দিকে (অর্থাৎ বাঁ দিকে)। আর বাঁ দিকেরগুলো লাগানো হয়েছে ডান দিকে।” বলছেন প্রবীণ ইঞ্জিনিয়ার তথা বেয়ারিং বিশেষজ্ঞ অচ্যুত ঘোষ। রবিবার সকালেই ক্যামেরা নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হয়েছিলেন আইআইটি-র ওই শিক্ষক তথা ইন্ডিয়ান রোড কংগ্রেসের স্টিল ব্রিজ কমিটি ও বেয়ারিং কমিটির সদস্য। এ দিন তাঁর দাবি, বেয়ারিং বসানোয় ভুল না-হলে হয়তো এ যাত্রা উড়ালপুলটার সলিলসমাধি ঠেকানো যেত।
শুধু অচ্যুতবাবুই নন। যারা উল্টোডাঙা উড়ালপুল নির্মাতাদের বেয়ারিং সরবরাহ করেছিল, সেই সংস্থার তরফেও কিন্তু বেয়ারিং বসানোয় ভুলের কথা বলা হচ্ছে। সুইৎজারল্যান্ডের মাগেবা ব্রিজ প্রডাক্টস-এর একটি সাবসিডিয়ারি সংস্থার বেয়ারিং নেওয়া হয়েছিল এই উড়ালপুলের কাজের জন্য। এ দেশের বহু উড়ালপুলেই তাদের বেয়ারিং ব্যবহার করা হয়। ওই সংস্থার কলকাতার এক কর্তার কথায়, “দুর্ঘটনার পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে বুঝেছি, ভুল করে উড়ালপুলের বাঁকের বাঁ দিকের বেয়ারিং ডান দিকে বসানো হয়। খুবই বিপজ্জনক ভুল।” ওই কর্তা জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত উড়ালপুল-সংক্রান্ত তদন্তে তাঁদের কেউ ডাকেনি। ডাকলে সব রকমের সহযোগিতায় তাঁরা প্রস্তুত।
এই নিয়ে কী বলছে উড়ালপুলটির নির্মাণকারী সংস্থা ম্যাকিনটস বার্ন? তাদের কর্তা শম্ভু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “কেএমডিএ-র ইঞ্জিনিয়ারদের উপস্থিতিতেই আমরা বেয়ারিং বসিয়েছিলাম। ঠিক মতো কাজটা হয়েছে কি না, তা ওঁরাও খতিয়ে দেখেছিলেন।” তবে বেয়ারিং বসানোয় ভুল হলে যে বড় বিপদ হতে পারে, তা তিনি মেনে নিয়েছেন।
বেয়ারিং বসাতে এই ভুলের জেরে কী হয়েছে? ইঞ্জিনিয়ারদের পর্যবেক্ষণ, উড়ালপুলের কাস্তের মতো ডান দিকের বেয়ারিং অর্থাৎ পট বেয়ারিংয়ের কাজ ছিল সেতুর ওজন ও যানবাহনের চাপ সামলানো। ওই বাঁক ধরে যেতে গেলে স্বাভাবিক নিয়মেই কেন্দ্রাতিগ বল বা সেন্ট্রিফিউগল ফোর্সের ঠেলায় যে কোনও গাড়ি ডান দিকে কিছুটা সরে যায়। এর ফলে, বাঁ দিকে কিছুটা বাড়তি টান সৃষ্টি হয়। সেই দিকের বেয়ারিং-এর তাই একই সঙ্গে টান ও চাপ দু’টোই সামলাতে দক্ষ (আপলিফ্ট বেয়ারিং) হওয়া উচিত ছিল।
অচ্যুতবাবুর দাবি, “দেখে যা বুঝেছি, গোলমালটা এখানেই।” অর্থাৎ, ভুলবশত, বাঁ দিকে আপলিফ্টের বদলে বসানো হয়েছে পিট বেয়ারিং। আর ডান দিকে বসানো হয় এর উল্টো। কিন্তু সেখানে তো চাপ ও টান, এই দুই সমস্যা সামলানোর মতো বেয়ারিং বসানোর কথাই নয়। ফলে ডান দিকে থাকা মার্বেল বোঝাই ট্রাকের চাপের ফলে তৈরি হওয়া টান সামলাতে পারেনি বাঁ দিকের বেয়ারিং। তাই বেয়ারিং খুলে তলার গার্ডারসুদ্ধ সেতুর অংশ পাক খেয়ে নীচে পড়ে বলেই অচ্যুতবাবুর দাবি।
ঘটনাস্থলের ছবি থেকেই বেয়ারিং বসানোর ভুলটা স্পষ্ট উঠে আসছে বলে মনে করছেন একাধিক বিশেষজ্ঞ। সেতুর খসে-পড়া গার্ডারের যে দিকটা ভিআইপি রোডের দিকে ছিল, সেখানে কোন বেয়ারিং লেগে আছে দেখেই এই সিদ্ধান্তে আসেন ইঞ্জিনিয়ারেরা। ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ফলে যে বেয়ারিং খুলে আসে, তার কয়েকটি তথ্যপ্রমাণও তাঁরা তুলে ধরেছেন। তাঁদের মতে, উড়ালপুলের খুলে-পড়া বাঁকা অংশটি পাক খেয়ে পড়ার ধরন ও খালে আধডোবা লরিটির পড়ে থাকার ভঙ্গি থেকেও এটা প্রমাণ হচ্ছে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, শুরুতেই এই গোলমাল হয়ে থাকলে তখনই কেন দুর্ঘটনা ঘটল না? এ ব্যাপারে অচ্যুতবাবুর ব্যাখ্যা, “ভুল জায়গায় বেয়ারিং বসানোর জেরে সেতুর ভেঙে পড়া কিন্তু প্রথম দিন থেকেই অনিবার্য ছিল। এত দিন যে ভাঙেনি, সেটাই বরাত!”
বেয়ারিংয়ের মান কেমন ছিল, তা নিয়েও তদন্তের দাবি উঠেছে। এ দিন উপকরণের মান যাচাই করতে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা ঘটনাস্থলে গিয়ে তথ্যপ্রমাণও সংগ্রহ করেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই বেয়ারিং সরবরাহকারী সংস্থার কর্তারা বলেছেন, এই দাবি ঠিক নয়। তাঁরা জানিয়েছেন, উড়ালপুলের বাঁকের বাইরের দিকের (এ ক্ষেত্রে ডান দিক) জন্য ৪০০ টন চাপ সামলানোয় উপযুক্ত পট বেয়ারিং সরবরাহ করা হয়েছিল। আর বাঁকের ভিতরের দিকের (এ ক্ষেত্রে বাঁ দিক) জন্য একসঙ্গে ৪০ টনের সমকক্ষ টান ও ১০০ টন চাপ সামলানোর ক্ষমতাসম্পন্ন আপলিফ্ট বেয়ারিং দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বেয়ারিং বসাতে গিয়ে ওলটপালট হয়ে যায়।
ইঞ্জিনিয়ারদের অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, উড়ালপুল তৈরির কোনও পর্যায়েই কেন বেয়ারিং বসানোর গলদ কারও চোখে পড়ল না? দিল্লির কমনওয়েলথ গেমসের সময়েও একটি উড়ালপুলে বেয়ারিং-বিভ্রাট হয়েছিল বলে জানাচ্ছেন এক জন ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু সেটা উড়ালপুল চালু হওয়ার আগেই ধরা পড়ে। বেয়ারিংগুলি তখনই ঠিক জায়গায় বসিয়ে ভুল শুধরে নেওয়া হয়।
খুব ভোরে দুর্ঘটনাটি ঘটার পিছনেও যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন কোনও কোনও ইঞ্জিনিয়ার। তাঁরা বলছেন, দিনের অন্য সময়ে একাধিক গাড়ি অনেক কম গতিতে উড়ালপুলটির উপরে চলে। এর ফলে ভারসাম্য রক্ষা হয়। কিন্তু অত সকালে স্রেফ একটি ভারী লরি সেতুর মোচড়ের জায়গাটা দিয়ে দ্রুত গতিতে যাচ্ছিল। তাই এক দিকে চাপটা অস্বাভাবিক বেশি হয়ে যায়। তবে তাঁদের বক্তব্য, দিনের ব্যস্ত সময়েও যদি ওই ভারী লরিটি উড়ালপুলে উঠত, তখনও কিন্তু এমন অঘটন ঘটার আশঙ্কা ছিল।
ইঞ্জিনিয়ারদের একাংশ আবার কাস্তের মতো বাঁকটার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাবধানতা নেওয়ার বিষয়টিও মাথায় রাখার কথা বলেছেন। স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার তথা কেআইটি-র অবসরপ্রাপ্ত চিফ ইঞ্জিনিয়ার প্রবীরকুমার দে বলেন, “শুধু বেয়ারিংয়ের ভরসায় অত বড় একটা বাঁক রাখার ভাবনা সমর্থন করতে পারছি না। বাঁকের ভারসাম্য বজায় রাখতে অন্য কিছু ব্যবস্থা (যেমন বাড়তি ঠেকনা বা ক্যান্ডিলিভারের ব্যবস্থা) থাকাও জরুরি ছিল।”
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.