রোগ জানে সবাই। তবু উৎসাহ নেই দাওয়াই প্রয়োগে!
উল্টোডাঙার উড়ালপুল ভেঙে দুর্ঘটনার পরে তার দায় নিয়ে যথারীতি রাজনৈতিক চাপানউতোর শুরু হয়েছে। রাজ্য সরকারের অভিযোগ, বাম জমানায় বিধানসভা ভোটের আগে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সেতুর নির্মাণেই গলদ থেকে গিয়েছিল। আবার পূর্বতন সরকারের বক্তব্য, রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতিই দুর্ঘটনার আগাম আন্দাজ দিতে পারেনি। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে সত্য উদ্ঘাটন করা উচিত, যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়ানো যায়। কিন্তু এ সবের মাঝে যে প্রশ্নটি হারিয়ে যাচ্ছে, তা হল: এমন গুরুত্বপূর্ণ সেতু বা বাড়ির নির্মাণ কিংবা রক্ষণাবেক্ষণের ভার আদৌ সরকারি সংস্থার হাতে থাকবে কেন, যাদের পেশাদারিত্ব ও দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রযুক্তিবিদদেরই একাংশের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে? কেন আন্তর্জাতিক মানের পেশাদার ও বেসরকারি হাতে এই দায়িত্ব দেওয়া হবে না, যারা নিজেদের ব্যবসার স্বার্থেই এই কাজে মনোযোগী হবে?
বাম আমলে সরকারের কর্ণধারেরা বেসরকারি হাতে দায়িত্ব ছাড়ার ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা করেননি। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরেও তেমন কোনও উদ্যোগ নেই। অর্থাৎ, ঘটনার পরে পরস্পরকে দোষারোপের ‘ট্র্যাডিশন’ জারি থাকলেও মূল সমস্যার সমাধানের পথ এড়িয়ে চলেছে দু’পক্ষ। কী ভাবে?
দুর্ঘটনার পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে রবিবার পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম প্রাথমিক ভাবে রক্ষণাবেক্ষণের গাফিলতির কথা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। যদিও পুর দফতরেরই খবর, উড়ালপুলটির নির্মাণ শেষ হওয়ার পরে এক বছর পর্যন্ত সেটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল নির্মাণকারী সংস্থার হাতে। তার পর এত দিনেও সেই দায়িত্ব কাউকে দেওয়া হয়নি। ফিরহাদের অবশ্য দাবি, “রক্ষণাবেক্ষণের কোনও বিষয় এটা নয়। উড়ালপুল তৈরির সময় তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বোল্টিং সিস্টেমে হয়তো কোনও অসুবিধা হয়েছিল। কেএমডিএ-র প্রকল্প ছিল। যে ঠিকাদার সংস্থা কাজ করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হবে। ইঞ্জিনিয়ারদের ভূমিকাও দেখা হবে। তদন্ত তো হবেই। তা সত্ত্বেও আমরা তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে পরিদর্শন করাব।” পরে মন্ত্রীর নির্দেশে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ দল ভাঙা সেতু পরিদর্শনে যায়। তাঁদের রিপোর্ট হাতে পাওয়ার আগে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব নয় বলে সন্ধ্যায় পুরমন্ত্রী জানান। নির্মাণকারী সংস্থার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগও দায়ের করা হয়। কিন্তু এর পর থেকে নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বেসরকারি সংস্থাকে দেওয়ার কথা কি তাঁরা ভাববেন? মন্ত্রীর জবাব, “সেতু বা বাড়ি নির্মাণ কিংবা রোজকার ভিত্তিতে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বেসরকারি হাতে ছাড়া যায় না।”
উল্টোডাঙায় ভিআইপি রোড থেকে ই এম বাইপাসের সংযোগকারী উড়ালপুলটি নির্মাণের দায়িত্ব ছিল সরকারি সংস্থা ম্যাকিনটস বার্নের হাতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের সংস্থার মাথায় রাজনৈতিক আশীর্বাদ থাকে। বরাত পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের ১০% ‘ওয়েটেজ’-ও দেওয়া হয়। ফলে এ সব ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতার দিকটা এমনিতেই গৌণ হয়ে পড়ে। বরং এর থেকে বেসরকারি হাতে দায়িত্ব গেলে তুলনায় বেশি নিরাপত্তা পাওয়ার সম্ভাবনা, কারণ ভবিষ্যতে ফের কাজের সুযোগ না-হারানোর জন্যই বেসরকারি সংস্থা অনেক পেশাদার ভাবে কাজ করে থাকে।
তবে এর উল্টো মতও রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, সরকারি সংস্থা মানেই যে তার মান খারাপ হবে তা নয়। বরং ছোটখাটো বহু নির্মাণসংস্থাই মানের সঙ্গে আপোস করে। একই সঙ্গে, শাসক-বিরোধী দুই শিবিরেরই একাংশের বক্তব্য, বেসরকারি হাতে দায়িত্ব দিলে তারা ঠিকমতো কাজ করছে কি না, তা নিশ্চিত করতে আবার সরকারি নজরদারির প্রশ্ন উঠতে পারে! তার থেকে সরাসরি সরকারি নজরদারিই ভাল!
বাম আমলের পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য বা পূর্তমন্ত্রী ক্ষিতি গোস্বামীর ভাবনাও এ ক্ষেত্রে আলাদা নয়। ভোর রাতে দুর্ঘটনা ঘটায় বড় বিপর্যয় থেকে শহর বেঁচে গিয়েছে বলে মন্তব্য করে ক্ষিতিবাবুর মত, সরকারি ব্যবস্থা কাজে লাগিয়েই কলকাতার বিভিন্ন সেতু এবং বড় বাড়ির অবস্থা নিয়মিত খতিয়ে দেখা যায়। তাঁর কথায়, “পূর্ত দফতরে ছিলাম আমি। ওই দফতর ব্রিটিশরা এমন ভাবে পরিকল্পনা করে তৈরি করেছিল, যেখানে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটা সুন্দর ব্যবস্থা করা আছে। মহাকরণ ২৪০ বছরের বাড়ি। হাইকোর্টও পুরনো বাড়ি। সেগুলো পূর্ত দফতর ভাল ভাবেই রক্ষণাবেক্ষণ করেছে। রাজ্য সরকারকে অনুরোধ করব, একটা অঘটন ঘটে যাওয়ার পরে কলকাতার বিভিন্ন সেতু নিয়মিত পরিদর্শন করে খতিয়ে দেখা হোক।”
প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোকবাবুও বলেছেন, দুর্ঘটনার পরে রাজনীতি না-করে সেতুগুলির অবস্থা নিয়মিত খতিয়ে দেখা উচিত। তাঁর বক্তব্য, “দুঃখজনক ও উদ্বেগজনক ঘটনা। আশা করা যায়, সরকার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করবে। বাম আমল-বাম আমল এই সব না-বলে নিয়মিত পরিদর্শন
জরুরি। নিয়মিত খতিয়ে দেখলে এমন ঘটনা ঘটত না।” প্রাক্তন পুরমন্ত্রী যেমন তাঁদের আমলে উল্টোডাঙা উড়ালপুল নিয়ে তাড়াহুড়োর অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন, তেমন ক্ষিতিবাবুও বলেছেন, “কাজ শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালে। উদ্বোধন হয় ২০১১-র জানুয়ারিতে। তিন বছর খুব তাড়াহুড়ো বলা যায় না।” |