বাবা জ্ঞান দিয়ো না
আমার চোখে সহজেই জল আসে
নানা পটেকর ভীষণ বদমেজাজি। একটু সামলে কথা বলবেন। যে কোনও মুহূর্তে রেগে যেতে পারেন।
হ্যাঁ, এ সব কিছুই বলে দেওয়া হয়েছিল সাক্ষাৎকারের আগে। তাই ফোনে নানা পটেকরের নামটা ভেসে উঠতেই একটা উৎকণ্ঠা তৈরি হয়। কী বললে রেগে যাবেন না?
ভণিতা না করেই শুরু হল আলাপচারিতা। “ওহ্! কলকাতাতেও ‘দ্য অ্যাটাকস অব ২৬/১১’ শুক্রবার মুক্তি পেয়েছে? যা বলার সব তো ছবিতে বলেই দিয়েছি।”
যে দিন মুম্বইতে সন্ত্রাস হানা হল, সে দিন নানা ছিলেন গোয়াতে। “ভীষণ অসহায় মনে হয়েছিল নিজেকে। এত রাগ, এত বিতৃষ্ণা, কী ভাবে তৈরি হয়? আমি বুঝতে পারি যদি কেউ আমাকে বলেন যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে লোকের রাগ হয়। তবে এ রকম রাগ? কী কারণ থাকতে পারে, যে একজন আততায়ী একটা নিষ্পাপ শিশুকে এ ভাবে গুলি করতে পারে? ছবিটা করার সময় যত
ভেবেছি, তত মনে হয়েছে যে, সময় এসেছে নতুন করে মূল্যায়ন করার,” বলেন তিনি।
গলায় একটা অদ্ভুত শীতলতা।
কথা এগোতে থাকে। নানা বলে চলেন, ‘‘আমি মহারাষ্ট্র পুলিশের যুগ্ম কমিশনার রাকেশ মারিয়ার চরিত্রে অভিনয় করেছি। মনে আছে সেই মর্গের সিনটা? যেখানে কসাব বলেছিল রাকেশ যেন ওকে একবার ওর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেয়। আর তার পর কসাবকে নিয়ে যাওয়া হয় একটা মর্গে। ওই সিনটা আমার কাছে ঠিক এক টুকরো সিনেমা নয়। ওখানে অভিনয় করা যায় না। ওটা হয়ে যায়। যে কথাগুলো আমি ওই সিনে বলেছি, সেগুলো আমি নিজেও বিশ্বাস করি। ছবিতেও লাইনগুলো যে শুধুমাত্র কসাবকে বলা তা কিন্তু নয়। এগুলো বিশ্বাসের কথা। আমি কসাবের দিকে তাকিয়ে বলি: ‘তেরি উমর কে বেটা হ্যায় মেরে...’ আর তার পর বলতে থাকি কী ভাবে ওর বয়সি একজনকে জিহাদের নামে মিথ্যে বোঝানো হয়েছে। কোনও ধর্ম নেই যা মানুষকে এ ভাবে খুন করতে বলে। বরং সব ধর্মই তো ভালবাসা শেখায়...”
এমন একটা ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে সব চেয়ে কঠিন কী ছিল? “এই ছবিটা আমার কাছে ঠিক একটা সিনেমা নয়। এটা একটা সুযোগ, অনেকগুলো কথা বলার। সিনেমার জন্য ওই ঘটনাগুলোর পুনরুজ্জীবন করা সহজ নয়। বরং বেশ কষ্টকর সেটা। ডাবিং করতে হয়নি বলে বাঁচোয়া। না হলে দু’দুবার করে সেই এক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হত,” বলেন নানা।

রাকেশ মারিয়ার চরিত্রে নানা পটেকর
এই রকম একটা চরিত্র করার পর নিজের কতটা মানসিক ক্ষয় হয়? কেমন লাগে অভিনেতা হিসেবে বলতে যে, ‘আমি জানি না কোনটা ঠিক বা কোনটা বেঠিক। আসল কথা হল আমি জানি না কী করা উচিত’? নানা বলেন “একটা অদ্ভুত ক্যাথারসিস হয় নিজের মধ্যে। সিনেমাতে অভিনয় করার শেষে নিজেকে ডিটাচ করতে হয়। ইউ হ্যাভ টু অ্যাবানডন দ্য ফিলিং। তার পর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরতে পারবেন কিছু দিন পর। দেখুন রাকেশ মারিয়া তো আর খুব পরিচিত চরিত্র নন। তাই ওঁর হাঁটাচলা, হাবভাব, আমি সে ভাবে ছবিতে নকল করিনি। চেষ্টা করেছি ওঁর সাইকোলজিটা বুঝতে। একটা মানুষ নিজে থেকেই স্বীকার করেন যে কসাবকে প্রথম বার দেখার পর তাঁর সব চেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল কী ভাবে নিজেকে এবং নিজের ফোর্সের লোকেদের কসাবকে হত্যা করা থেকে আটকে রাখবেন!”
পরিচালক রামগোপাল বর্মার সঙ্গে সম্পর্ক ভাল? “ওকে তো আমি এই সে দিন বলেছি স্প্লিট পরিচালক। কী অসাধারণ ছবি বানিয়েছে এটা। আর তার আগে দেখুন কী বাজে সব ছবি বানিয়েছে। আমি ওকে মুখের ওপর এ সব বলতে পারি। এই ছবিটা করার সময় তো কিছু ক্ষেত্রে আমি নিজেও পরিচালনা করেছি। যে দৃশ্যগুলো সে রকম ভাল লাগেনি, আমি নিজেই বলেছি পরিচালনা করব। রামু আর আমার যা সম্পর্ক, তাতে আমি এটা করতে পারি,” নানার পাল্টা জবাব।
এতটা ভাবনা একটা চরিত্র নিয়ে? তা হলে কেন তাঁর মতো অভিনেতাকে পর্দায় তত দেখা যায় না? “হয়তো আমি ক্লান্ত,” বলেন তিনি। উত্তর দিতে গিয়ে ঠোঁটের কোণে একটা হালকা হাসিও থাকতে পারে তাঁর। বললেন, “সব ছবির অফার আমি নিই না। এই তো আমার বন্ধুর ছেলে একটা ছবি বানিয়েছিল। ‘অগ্নিপথ’-এর রিমেক। আমাকে বলেছিল একটা চরিত্র করতে। আমার ঠিক ওই রকম ভাবে ভায়োলেন্স দেখানোটা পছন্দ নয়। তাই বারণ করে দিয়েছিলাম। পরে সঞ্জয় দত্ত সেই চরিত্রটা করেন।” তা আজকালকার হিন্দি ছবি দেখছেন? “দেখুন, হলে গিয়ে দেখা হয় না। ভাল কাজ নিশ্চয়ই হচ্ছে। আমার নিজের ছবি হলে গিয়ে শেষ কবে দেখেছি তা মনে করতে পারব না,” স্বীকার করেন তিনি।
কেন? ‘অব তক ছপ্পন’? সেটাও হলে গিয়ে দেখেননি? “না। ওটা যখন টেলিভিশনে দেখানো হয়েছিল, তখন দেখেছিলাম। আর এখন তো ওটার একটা সিকোয়েলও তৈরি হয়ে গিয়েছে। আর দু’এক মাসের মধ্যেই দেখতে পাবেন সেটা,” বলেন তিনি।
অল্প বয়সে নানা খুব আক্রমণাত্মক ছিলেন বলে শোনা যায়। কেউ কিছু বলার আগেই দুমদাম যা তা বলে দিতেন। আবার সিনেমাতে অভিনয় করার সময়ও ওই আক্রমণাত্মক মনোভাবটাকে কাজে লাগাতেন। “আমার মধ্যে একটা সাফোকেশন ছিল। সিনেমা এমন একটা মিডিয়াম যেখানে আমি আমার সাফোকেশনটা বের করতে পারতাম। আজকে যে আমি রেগে যাই না তা নয়। তবে এখন অনেকটাই সংযত,” নানা বলেন।
এক সময় নানাকে বলা হত যে উনি বেশ একঘেয়ে ভাবে উঁচু পিচে একই ধরনের সংলাপ বলতে ভালবাসেন। আজকের নানা, বিশেষ করে ‘অ্যাটাক অব ২৬/১১’-এর নানা কিন্তু অনেক সংযত। “ছবিটা কী ধরনের তার উপর নির্ভর করবে অভিনয়টা। তেষট্টি বছর বয়সে এসে আমার মনে হয় সবে আমি সিনেমা কী সেটা বুঝতে শিখেছি,” বলেন তিনি।
শুনে অদ্ভুত লাগে, যে অভিনেতা এ বছর পদ্মশ্রী পেয়েছেন, তিনি বলছেন এত দিনে না কি তিনি সিনেমা বুঝতে শিখেছেন। এই না হলে নানা?
আর কী কী ভুল ধারণা আছে আপনার সম্পর্কে? উত্তরে নানা বলেন, “আমি ভীষণ নরম প্রকৃতির মানুষ। সেটা ক’জন জানেন? কোনও মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটলে আমার চোখে সহজেই জল আসে।” তার ঠিক পরেই আবার হেসে বলেন, “আর একটা কথা, খুব কম লোকই জানেন আমিও একজন রক্তমাংসের মানুষ।”
গল্প করেন নিজের পরিচালিত ‘প্রহার’ ছবির। “আড়াই বছর আমাদের সেনাবাহিনীর মরাঠা লাইট ইনফ্যানট্রিতে কাজ করেছিলাম ‘প্রহার’-এর শ্যুটিংয়ের সময়,” বললেন নানা। আজকাল একজন অভিনেতা তো বড় জোর এক বছর সময় দেন একটা ছবি করতে। সেখানে আড়াই বছর আর্মিতে থাকা? “হয়তো আমি স্লো লার্নার। শিখতে দেরি হত আমার। আজও যখন পিছন ফিরে দেখি, ‘প্রহার’ আমার কাছে একটা চরম দগদগে অভিজ্ঞতা,” উত্তর নানার।
নিজের ভাল কাজের মধ্যে আর কোন কোন ছবিগুলোকে রাখবেন? “‘অঙ্কুশ’, ‘খামোশি’, ‘অগ্নিসাক্ষী’। আরও আছে...”
আজকাল অনেক শিল্পী ভাল অভিনয় করলেই আন্তর্জাতিক ছবি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সেই মোহ তাঁর ছিল না কেন? নানার পাল্টা প্রশ্ন, “কী ভাবে করব আন্তর্জাতিক ছবি? ছোটবেলায় তো হীনমন্যতায় ভুগতাম। গ্রামের স্কুলে তো ক্লাস ফাইভে উঠে এ বি সি ডি শিখেছি। ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ ছিলাম না। আজও আমি যতটা স্বচ্ছন্দ মরাঠি বা হিন্দিতে, ততটা সহজে কি আমি ইংরেজি বলতে পারি? এই যে কথা বলছি অনেকটাই তো টুটাফুটা ইংরেজিতে বলছি, তাই না?”
টুটাফুটা ইংরেজি বলাটা হয়তো বেশি বিনয় হয়ে যায়।
তাই কাট বলে অন্য প্রসঙ্গে যাওয়া হল। জীবনে সাফল্যের মাপকাঠিটা ঠিক কী? “যখন আর্মি অফিসারেরা এসে বলেন আমরা আপনার ‘প্রহার’ দেখেই ভারতীয় সৈন্য শিবিরে নাম লেখানোর স্বপ্ন দেখেছি, তখন আনন্দ হয়। এটাই সাফল্য।”
নিজের জীবনের সব চেয়ে প্রিয় সংলাপ কী? “২০০৫ সালে একটা মরাঠি ছবি করেছিলাম। নাম ‘পক পক পকাও’। সেখানে দু’টো সংলাপ ছিল যার ইংরেজি অর্থ হল, “লাইফ ইজ বিউটিফুল। ইউ হ্যাভ টু মেক ইট মোর বিউটিফুল। এগুলোই আমার সব থেকে প্রিয় লাইন,” নানা বলেন।
আর সেই বহুল প্রচলিত সংলাপ? “এক মচ্ছর শালা আদমি কো হিজড়া বানা দেতা হ্যায়...”
“লোকে তো শুধু এই লাইনটাই জানে। ‘যশবন্ত’ ছবি থেকে। জানেন কি যে ওই লাইনটা একটা কবিতার অংশ? যেটা আমার নিজের লেখা। লাইনগুলো ছিল এ রকম ‘এক মচ্ছর সালা আদমি কো হিজড়া বনা দেতা হ্যায়
এক খটমল পুরি রাত কো অপাহিজ কর দেতা হ্যায়
সুবহ ঘর সে নিকলো
ভিড় কা এক হিসসা বনো
শাম কো ঘর যাও, দারু পিও, বাচ্চে পয়দা করো
ঔর সুবহ ফির এক বার মর যাও
কিউকি আত্মা অউর অন্দর কা ইনসান মর চুকা হ্যায়
জিনে কে লিয়ে ঘিনহোনে সমঝোতা কর চুকা হ্যায়
এক মচ্ছর সালা আদমি কো হিজড়া বানা দেতা হ্যায়
।’
এত বড় একটা কবিতা। তবু আজও লোকে শুধু আমাকে ওই ‘এক মচ্ছর আদমি কো হিজড়া বনা দেতা হ্যায়’ নিয়েই কথা বলে!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.