|
|
|
|
ফিল্ম সমালোচনা |
খুন কা ফাউন্টেন, মওত কা মাউন্টেন
গ্রেনেড, গুলি, সন্ত্রাস থাকলেও বীরগাথাটাই যে উধাও! লিখছেন সুমন দে |
দ্য অ্যাটাকস অব ২৬/১১
নানা পটেকর, সঞ্জীব জয়সোয়াল |
৪ |
১০ |
|
স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সব চেয়ে নৃশংস জঙ্গি আক্রমণের অভিঘাত বোঝাতে রামগোপাল বর্মার ছবির প্রথমার্ধ জুড়ে শুধুই রক্ত। প্রায় প্রতিটি ফ্রেমে গুলি, গ্রেনেড আর তাজা রক্তস্রোত দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এ ছবির ট্যাগলাইন হতেই পারে ‘খুন কা ফাউন্টেন, মউত কা মাউন্টেন, ডেঞ্জার, ডেঞ্জার, ডেঞ্জার।’ কোথাও গল্প দানা বাঁধে না। কোনও কেস স্টাডি নেই। এক সময় ভয় হয় রামু শুধুমাত্র ১৬৬ জন অসহায় মানুষের মৃত্যুদৃশ্য দেখিয়েই ছবি শেষ করবেন না তো! আবেগের সিনেম্যাটিক মুহূর্ত তৈরি না হওয়ায় আখেরে এই ছবি বড় জোর বাস্তবে ঘটা ভায়োলেন্সের আয়না। ‘ট্র্যাজেডি’ হয়ে ওঠা এর হল না। কাজেই ‘রঙ্গিলা’, ‘সত্য’, ‘সরকার’-এর রামু ফিরে এলেন না। পর্দা জুড়ে ১১৮ মিনিট ধরে চলল ‘আগ’-এর রামুর সন্ত্রাস।
সেই সন্ত্রাস-কবলিত মুম্বইয়ের প্রতি সেকেন্ডের লাইভ কভারেজের সঙ্গে পেশাদারি কারণে আমরা যারা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম, প্রত্যেকের মনে হয়েছিল এই নাশকতা টেলিভিশন কভারেজের ক্ষেত্রেও ঐতিহাসিক। ঝুলন্ত হেলিকপ্টার থেকে দড়ি ধরে সশস্ত্র এনএসজি কম্যান্ডোরা যখন নেমে আসছেন অ্যাকশন স্পটে, রুদ্ধশ্বাস সেই অপারেশন নিউজ চ্যানেলে লাইভ দেখেছিল গোটা পৃথিবী। তার পর মিডিয়ার অতিসক্রিয়তা নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্ক, সরকারি নির্দেশিকা, চ্যানেলগুলোর আত্মনিয়ন্ত্রণের চেষ্টা সবটাই ইতিহাস। ভেবেছিলাম টিআরপি-র লড়াই নিয়ে পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে কিছু সমালোচনা গিলতেই হবে মাল্টিপ্লেক্সে বসে। ‘পিপলি লাইভ’-এ যেমনটা হয়েছিল। কিন্তু কোথায় কী! এ ছবিতে নরিম্যান হাউজের হামলা নেই, ওবেরয় হোটেলের আক্রমণ নেই, এমনকী কম্যান্ডোদের প্রতি-আক্রমণের বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। কাজেই যাঁরা গাদা বন্দুক আর থ্রি-নট-থ্রি দিয়ে এ কে ফর্টিসেভেন আর অ্যাসল্ট রাইফেলের মোকাবিলা করলেন অসীম সাহসে, তাঁদের স্যালুট করার কোনও সুযোগই তৈরি হল না এ ছবিতে। |
কসাব: তবে রামগোপাল বর্মার |
কারকারে, সালাসকর, কামতেদের আদল অভিনেতাদের চেহারায় থাকলেও, তাঁদের প্রতিরোধের বীরগাথাটাই উধাও।
প্রায় সাত বছর আগে এবিপি আনন্দে যখন অপরাধমূলক ঘটনার নাট্যরূপান্তর শুরু করি, তা রীতিমতো বিতর্ক উস্কে দিয়েছিল। বাজেটের চাপে এবং প্রয়োজন নেই বলে তা কখনও ‘সিনেমা’ হয়ে ওঠেনি। রামুর এই ছবিও কোনও নিউজ চ্যানেলের হাই-বাজেট ডকুমেন্টারির যতটা কাছাকাছি, সিনেমার মাহাত্ম্য থেকে ততটাই দূরে। এমনকী মিডিয়ায় বহুচর্চিত ‘মউলা মউলা দেবা দেবা’ গানটিও টেলিভিশন মন্তাজের ওপরে উঠতে পারেনি দৃশ্যায়নের ক্ষেত্রে। ছবির দ্বিতীয়ার্ধে পরিচালক নিজেই এক সময় গুলিয়ে ফেলেছেন তাঁর ছবির বিষয় ২৬/১১, না কসাবের জীবনী।
লম্বা বিরতির পর ফেরত এসে এ ছবিতেও নানা পটেকর আরেকবার প্রমাণ করে দিলেন যে আধুনিক বলিউডেও তাঁকে ‘না-না’ বলার জায়গা তৈরি হয়নি। মর্গের দৃশ্যে জিহাদের আসল ব্যাখ্যা দেওয়ার অভিনয়টুকু এ ছবির সম্পদ। তবে চিত্রনাট্যকার রোমেল রডরিগ্স নাটকীয় মুহূর্ত তৈরিতে ভরসা রেখেছেন শুধুমাত্র দীর্ঘ ক্লান্তিকর সংলাপের ওপর। প্রশংসা করতে হয় শিল্প নির্দেশক উদয় সিংহেরও, যিনি আড়াই কোটি টাকা খরচ করে তাজ হোটেলের রেপ্লিকাটি খাসা বানিয়েছেন। লো লাইট শ্যুট আর লো অ্যাঙ্গল ক্যামেরার নাচানাচির বদ অভ্যেস পরিচালক রামু এ ছবিতে কিছুটা কাটাতে পারলেও, বন্দি কসাবের আহত চোখের চড়া যাত্রাসুলভ মেকআপ কী করে তাঁর চোখ এড়াল, সে প্রশ্ন থেকে যায়। মুম্বই গেলে বহু বার যাওয়া ‘লিওপোল্ড ক্যাফে’-র মালিককে পর্দায় নিজের ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখে পুলকিত হয়েছিলাম। কিন্তু সেই চমক ব্যবহারেও কার্পণ্য করলেন পরিচালক। তবে ভূয়সী প্রশংসা করতেই হবে কাস্টিং পরিচালককে, যিনি পাঁচশোটি সচিত্র আবেদনপত্রের মধ্যে থেকে সঞ্জীব জয়সোয়ালকে আজমল কসাবের ভূমিকায় নির্বাচিত করেছেন। চেহারার সাদৃশ্য এতটাই যে দুর্বল অভিনয়ও তাতে অনেক জায়গায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে। |
‘দ্য অ্যাটাকস অব ২৬/১১’ ছবির একটি দৃশ্য |
কসাবের ফাঁসির দৃশ্য ফিরিয়ে নিয়ে গেল আজ থেকে ঠিক এক দশক আগে। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের ফাঁসির পর ফাঁসুড়ে নাটা মল্লিককে জেল থেকে সটান তুলে নিয়ে গিয়েছিলাম স্টুডিয়োয়। তা নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। মনে পড়ল প্রয়াত নাটা যে দিন বর্ণনা করেছিলেন, আগাগোড়া শান্ত থেকেও ফাঁসির মুহূর্তে ধনঞ্জয়ের অস্থিরতা। ছবিতে কসাবের শেষ মুহূর্তও হুবহু তাই।
এ ছবি তৈরি করতে গিয়ে সুযোগ অবশ্য কম পাননি রামগোপাল বর্মা। সত্যিকারের লোকেশন ব্যবহারের ঢালাও অনুমতি, ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস স্টেশনে ছবির শেষ শট নেওয়ার সুযোগ, তদন্তকারী সব ক’টা সংস্থার যাবতীয় তথ্যভাণ্ডার এবং পাঁচ বছর ধরে অঢেল রিসার্চের সময়। এমনকী জঙ্গি হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঘটনাস্থলে রেকি করতে গিয়ে রামু টলিয়ে দিয়েছিলেন বিলাসরাও দেশমুখের গদিও। তবু লাদেন হত্যা নিয়ে সম্প্রতি তৈরি ক্যাথরিন বিগেলোর অস্কারজয়ী ‘জিরো ডার্ক থার্টি’-র আশেপাশেও পৌঁছতে পারল না এ ছবি।
ঘটনাচক্রে গত বছরের একুশে নভেম্বর মুম্বইতে ছিলাম। কাকভোরে খবর এল কসাবের ফাঁসির। মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখলাম, অভিঘাতহীন স্বাভাবিক মুম্বই। কর্মব্যস্ত মানুষ খবরটা অসীম গুরুত্ব দিয়ে শুনলেন বটে, তবু আবেগের আতিশয্য নেই। নেই উল্লাসের বাড়াবাড়িও। এটাই তো সভ্যতা। এটাই আধুনিকতা। সেলাম মুম্বই।
১১৮ মিনিটে এই স্পিরিটটাকে ধরতেই ফেল করলেন রামু। |
|
|
|
|
|