|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২...
অন্যস্রোত |
|
মনোজ মিত্র |
ভাল করে লোকের চোখে পড়ার আগেই কখন যে হারিয়ে গেছে জীবনের প্রথম বইটা ব্যর্থতার কোন লজ্জা লুকোতে কখন যে সন্তর্পণে পালিয়ে গেল অকালজাতক সেই ছোটগল্প সংকলনটা সেটা এক রহস্যগাথা। আর গেছে সে এমন করে বেলা বাড়তে রোদ চড়তে ভোরের শিশির যেমন নিশ্চিহ্ন হয়। একদা বৈঠকখানা বাজার থেকে মস্ত এক কাঠের সিন্দুক কিনিয়ে এনে মা বলেছিল, ‘তোর বই-খাতাপত্তর যখন-তখন হারিয়ে যাচ্ছে, অশান্তি না করে লেখাজোকা সব এই সিন্দুকে ফেলে রাখিস, দরকারে পেয়ে যাবি।’ সিন্দুক নামক সেই স্ফীতোদর বেঁটেখাটো দৈত্যটাকে যে কোন ভরসায় অ্যাদ্দিন ধরে ঘরে পুষছি কে জানে? ক’দিন ধরে আঁতিপাঁতি ঘাঁটাঘাঁটি করেও বইখানার চিহ্নমাত্র যখন উদ্ধার করা গেল না, বুঝলাম, আমার ‘রিসাইক্ল বিন’ উড়িয়ে দিয়ে বিদায় নিয়েছে ‘অন্যস্রোত’ ছাপ্পান্ন বছর আগে গত শতকের ’৫৬-’৫৭ সালে কলেজ-ইউনিভার্সিটির দশ জন নবীন গল্পকারের দশটি ছোটগল্প নিয়ে গাঁথা সেই বইটা যার সম্পাদনা এবং প্রকাশনার দায়িত্ব বর্তেছিল আমার ওপর।
তখন স্কটিশ চার্চ কলেজে দ্বিতীয়-তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আমি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অগ্রণী ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটেছিল অগ্রজপ্রতিম অধ্যাপক গবেষক ডক্টর রামদুলাল বসুর হাত ধরে। ‘অন্যস্রোত’-এ গল্প-লেখকের তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ জন লেখকের সঙ্গে আমরা স্কটিশ চার্চ কলেজের পাঁচ সহপাঠী আমি, পার্থপ্রতিম চৌধুরী, অতনু সর্বাধিকারী, সুজিত সেন, পার্থ ঘোষ। ‘অন্যস্রোত’ নামটি দিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। দু-তিন পাতার মুখবন্ধটিও তাঁর। মনে আছে, তিনি লিখেছিলেন, ‘লেখকেরা কেউই বেশি দিন অপরিচয়ের আড়ালে থাকবেন না।’ ভবিষ্যদ্বাণীটি হয়তো সত্য, আবার সত্য নয়ও। জীবনে কমবেশি খ্যাতি পরিচিতি মিলেছে মোটামুটি সবার, কিন্তু গল্পলেখক হিসেবে কাউকেই আর পাওয়া যায়নি। নারায়ণবাবুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শিশিরকুমার দাশ, রামদুলাল বসু, ডঃ পরিমল বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ ঘোষ কৃতী এবং সুপরিচিত অধ্যাপক। তাঁদের লেখাপড়ার জগৎটাই ভিন্ন। একমাত্র শিশিরকুমার দাশ ছাড়া সৃষ্টিশীল সাহিত্যে ওঁদের কারওরই তেমন কাজকর্ম নেই। আর বাংলা থিয়েটারে নাটককার শিশিরকুমার দাশের অবদান অবশ্যই স্বতন্ত্র মর্যাদার।
আর আমাদের পার্থপ্রতিম চৌধুরী জীবনে গল্প লিখেছিলেন ওই একটাই। তাঁর খ্যাতির সবটুকুই মঞ্চে-চলচ্চিত্রে। ‘ছায়াসূর্য’, ‘শুভা’ ও ‘দেবতার গ্রাস’ কিংবা ‘যদুবংশ’-র মতো ছবি ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে ঠাঁই পাবে। ফাঁকে ফাঁকে কবিতাও লিখেছেন কিছু। পার্থ ঘোষকে চিনেছে লোকে আবৃত্তিকার হিসেবে। পার্থ-গৌরী দম্পতি বাংলার অগ্রগণ্য বাচিকশিল্পী। অতনুর গল্পের হাত ছিল ঈর্ষা করার মতো। ‘অন্যস্রোত’-এর সে-ই একা কিছু দিন গল্প লেখার চর্চা করে গেছে। ষাট-সত্তরের দশকে ‘দেশ’ পত্রিকায় তার তিনটি গল্পই প্রশংসা কুড়িয়েছিল পাঠকদের। কিন্তু মনেপ্রাণে অতনু এক যাযাবর। যেটা ও ভাল পারে, সেটা ও যত তাড়াতাড়ি পারে ছেড়ে দেবে। গল্প লেখা, অধ্যাপনা, নাটক লেখা, উর্দু শেখা, জন স্টুয়ার্ট মিল-এর ওপর গবেষণা, উচ্চাঙ্গ সংগীতে তালিম নেওয়া পর পর ঘর বদলানো চলেইছে তার।
উত্তর কলকাতার বেলগাছিয়ায় আছি তখন। অদূরে টালা পার্কের উল্টো দিকে পাড়ার বন্ধু আবীরদের ফ্ল্যাট। নিজে সে কোনও দিন লেখালেখির মধ্যে ছিল না ঠিকই, তবে তার পরিবারে লতায়পাতায় শিল্পকলা সাধনা এমনই পরিব্যাপ্ত, গ্রন্থ প্রকাশের মতো উদ্যোগে স্বভাবতই শামিল হতে চাইল সে। তক্ষুনি প্রচ্ছদের দায়িত্ব চেয়ে নিল। টালা পার্কের ফ্ল্যাটবাড়িটির সর্বোচ্চ তলে সন্ধেবেলা কোলের ওপর বেহালা রেখে, ছড়টি হাতে নিয়ে, চোখ বন্ধ করে ওর বাবা চুপ করে বসেছিলেন। বিনা ভূমিকায় আবীর শুরু করল, আমার এই বন্ধু একটা ছোটগল্পের সংকলন বার করবে, ওর সঙ্গে আমিও আছি। ও চায় তুমি প্রচ্ছদটা করে দাও। আবীরের বাবা কিন্তু জানতেও চাইলেন না বইয়ের প্রকাশক কে বা শিল্পীর দক্ষিণামূল্য কত। চোখ না খুলেই শুনতে চাইলেন, বইয়ের নাম ঠিক হয়েছে? নামটা শুনেই পূর্ববৎ মুদ্রিত নয়নেই আত্মনিমগ্ন শিল্পী অন্নদা মুনশী হাতের ছড়টি শূন্যে ভাসিয়ে দু-দু’বার অন্যস্রোত শব্দটা লিখে জানিয়ে দিলেন, সোমবার সকালে পেয়ে যাবে। কলকাতায় আমি তখন নবাগত। জানব কী করে অন্নদা মুনশীর তুলির টানের অক্ষরসজ্জার বিশেষ সমাদর করতেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়।
নাম, মুখবন্ধ এবং প্রচ্ছদটি হাতে পেতে সে দিন মনে হয়েছিল, একটা বই বানাতে আর তো মাত্র বাকি থাকে ছাপার জন্যে কাগজ কেনা, প্রেস ঠিক করা, প্রুফ দেখা আর দফতরি খুঁজে নিয়ে বাঁধাই-ছাঁদাই করে ব্যাগে ভরে কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানে বিক্রিবাটার জন্যে পাঁচখানা করে বই জমা দেওয়া, আর এ সব তুচ্ছ কর্মের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। শেয়ালদায় এক আত্মীয়ের দোকান থেকে সর্বোৎকৃষ্ট কাগজ সংগ্রহ করেছিলাম, বাজারের অর্ধেক মূল্যে। গৌরীবাড়ির প্রেসটি ছিল কলেজের বন্ধুর কাকার। বই বাঁধাইয়ের লোকটি আবার প্রেসের কাকার হাতের মুঠোয়। তরতর করে কাজ এগিয়ে গেল। বড় খরচপাতির ঝড়ঝাপটা থামাতে পারলেও, শেষ অবধি খুচরোখাচরা যা বাকি থেকেছে, বাঁশবাগানের বৃষ্টির মতো তা কেবল লাগাতার ঝরতেই লেগেছে টিপ...টিপ...টিপ।
কলেজ স্ট্রিটে ছড়িয়ে দেওয়া বইগুলোর ক’খানা বিক্রি হয়েছে বা আদৌ হয়েছে কি না, শেষ অবধি খবরও রাখা যায়নি তার। ছাপা হয়েছিল বোধহয় শ’তিনেক। যার থেকে তিনখানা বই তৎকালীন বিধি অনুযায়ী জমা দিতে হয়েছিল আলিপুরের জাতীয় গ্রন্থাগারে। সেজেগুজেই গিয়েছিলাম আলিপুরে। তখনও সগর্বে ভাবছিলাম, জাতীয় গ্রন্থাগারে আমাদের কীর্তি সুরক্ষিত থাকবে। সাত দিন পরে নিজের বই নিজে চাইতে গিয়ে আর তার টিকিও দেখতে পাইনি। তবু প্রথম তিন মাস নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে কখন রাত ফুরিয়ে গেছে। কখনও বা দেখা গেছে বালিশের ওপরে আমি, নীচে আমার বই।
‘অন্যস্রোত’ ধূসর হয়ে আসছে, সেই সঙ্গে বইটায় লেখা আমার সেই গল্পটাও। শ্মশানের বগাবুড়ো, বেতনাচরে শবদাহ আর দিনরাত নেশায় ডুবে থাকা ছাড়া যে অন্য কিছু বুঝত না, পৌঁছে গিয়েছে নেশার সর্বোচ্চ চুড়োয় নিত্য এক বার জিভের ডগায় সাপের ছোবল খায়। ধান কাটা হয়ে গেলে মাঠ কুড়িয়ে খায় তার বউটা, বনজঙ্গলের শাকপাতা, ইঁদুর-ব্যাঙও। কিন্তু ওতে কি পেট ভরে বগার ভরা-বয়সি বউটার? নদীর চর ফাটিয়ে গাল পাড়ে বগাকে। স্বামীর সঙ্গে শারীরিক, মানসিক কোনও সম্পর্কই নেই তার। এক দিন ভর সন্ধেবেলা মুখরা বউটাকে সাপে কাটল। বগার সে দিন ছোট-বড় কোনও নেশাই জোটেনি। শরীর আইঢাই করছে। কুপি জ্বালিয়ে দেখে বউয়ের বুড়ো আঙুলের ডগায় সাপেকাটা দাগ, সূঁচের মাথায় রক্তবিন্দু হেন চিহ্ন। চরে লুটিয়ে পড়ে বউটা ছটফট করছে। তার ভরা বুকের ওঠানামা জোয়ারের ঢেউয়ের মতো বাড়ছে। অনাবৃত শরীর নীল হয়ে আসছে। নীলবর্ণ মানুষ যে এত রূপের হয়, বগাবুড়ো আগে তা জানত না। অথচ কম অনাবৃত দেহে তো আগুন ধরায়নি সে! বউয়ের পায়ের বুড়ো আঙুলটা মুখে পুরে পরম যত্নে চুষতে লাগল বগা গল্পটা এখানেই বোধহয় শেষ।
প্রথমে কলেজের দেওয়াল পত্রিকায় লিখি। সামান্য অদলবদল করে কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশের জন্য জমা দিই। ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপকমশাই জিগ্যেস করলেন, শেষ পর্যন্ত কী হল? বউটি বাঁচল, না আঙুলের বিষ টেনে তুলে লোকটার নেশা হল? দুটোর কোনওটাই যে সম্ভব নয়, তা জানো না? কী ভেবে লিখেছ গল্পটা? এর পর কী হয়েছিল লোক দুটোর? দিশেহারা হয়ে জানিয়েছিলাম, যে পর্যন্ত লিখেছি, ওই পর্যন্তই জানি স্যর। গল্প যেখানে শেষ, চরিত্ররাও সেখানে শেষ। অতি বড় লেখকও বলতে পারেন না, তাঁর সৃষ্ট নরনারীর পরিণতি কী হবে, বা শেষ পর্যন্ত হতে পারে। অধ্যাপকমশাই বিরক্ত মুখে লেখাটা ঠেলে দিয়ে বলেছিলেন, জেনেবুঝে তার পর ছাপতে দিয়ো।
জীবনের কোনও ব্যর্থতাকেই বেশি ক্ষণ বইতে পারি না। তপ্ত চাটুর ওপর এ পিঠ-ও পিঠ করে কাঁচা রুটি সেঁকে তাকে ফুলকো খাদ্য বানিয়ে নেওয়ার মতো, ব্যর্থতাকে নানা দৃষ্টিকোণে নিরীক্ষণ করে তাকে সফলতা প্রমাণ করার একটা জিদ কিংবা বায়না আমার আছেই। এই ‘নেশা’ গল্পটাই বেরিয়েছিল ‘অন্যস্রোত’-এ।
এর পর বছর দেড়েক লিখিনি। ১৯৫৯-এ প্রথম নাটক লিখি। তার পর থেকে নাটকই লিখছি। |
|
|
|
|
|