প্রবন্ধ়...
এ যুদ্ধ অবধারিত ছিল
ই ভয়টাই ছিল। শেষ পর্যন্ত কি তবে সেই চেনা পথেরই আর এক পথিক হতে চলেছে বাংলাদেশ? স্বতঃস্ফূর্ত, অহিংস নাগরিক আন্দোলন থেকে ক্রমে হিংসাদীর্ণ আক্রমণ, দমন, গৃহযুদ্ধ, এবং হয়তো-বা শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ: পরিচিত ধারাই কি আবার আমরা দেখতে চলেছি সে দেশে? পরিস্থিতি ও উপলক্ষ যদিও খুবই আলাদা, তবু ফলাফলটা কি আরব বসন্তের মতোই হবে? সমস্ত আশা-দুরাশার কুয়াশা কাটিয়ে, নাগরিক আন্দোলনের যাবতীয় সম্ভাবনার বিনাশ ঘটিয়ে, জঙ্গি মৌলবাদের ঘনিষ্ঠ রাজনীতিই চূড়ান্ত জয় লাভ করবে?
এক মাস হতে চলল, শাহবাগ আন্দোলনের মুখগুলো এখনও অক্লান্ত উদ্ভাসিত। এ দিকে ভয়টা ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ছে। জামাত-এ-ইসলামি দাঁতনখ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে দেশ জুড়ে। পুলিশও ফুঁসে উঠছে। জামাতের তাণ্ডব থামাতে গিয়ে পুলিশকে আক্রমণাত্মক হতে হচ্ছে, নিহতদের অধিকাংশই দেখা যাচ্ছে জামাত-দলভুক্ত। এই আশঙ্কাও বাড়ছে যে পুলিশ, তথা সরকার, তথা আওয়ামি লিগের বিরুদ্ধে বিরোধী বিএনপি এবং জামাতের ‘গণহত্যা’র অভিযোগ সমাজের এক বড় অংশের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। ও দিকে জামাতের পক্ষ থেকে শাহবাগের নেতাদের বিরুদ্ধে খুনের হুমকি জারি হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি-র সঙ্গে মিলে জামাত প্রচার করছে ‘ইসলাম ইন ডেঞ্জার’। বিএনপি জামাতের পক্ষ নিয়ে ফেলায় বড় সংকটে বাংলাদেশ। দেশ এখন আড়াআড়ি দ্বিধাবিভক্ত।
অথচ কিছু কাল আগেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে বিএনপি কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, মুক্তিযুদ্ধের অতি-স্পর্শকাতর প্রশ্নে রাজাকারদের পক্ষে (এবং আওয়ামি লিগ সরকারের বিপক্ষে) দাঁড়িয়ে প্রায়-আসন্ন নির্বাচনে লড়তে নামা উচিত কি না, বুঝে উঠতে পারছিল না। এমনকী শাহবাগ আন্দোলনের ফল হিসেবে ফাঁসির রায় মঞ্জুর হওয়ার পরও সেই রায়ের বিরুদ্ধে তাদের দলীয় ক্ষোভ প্রকাশ করতে তারা অনেকটা বেশি সময় নিয়ে ফেলল, সম্ভবত দলের ভিতরের টানাপড়েনের জন্যই। শেষ পর্যন্ত গত শুক্রবার সব দ্বিধার অবসান, জামাত-রাজনীতির আঁচলে প্রবেশ।
তবে কি শাহবাগ আন্দোলন যুদ্ধাপরাধ-সংক্রান্ত প্রশ্নেই সীমিত থাকলে বিএনপি-র কিছু আত্মিক সংকট হলেও হতে পারত? যুদ্ধাপরাধ পেরিয়ে আন্দোলনের লক্ষ্য জামাত-বিরোধিতা হয়ে উঠতেই কি বিএনপি-র গতি নির্ধারিত হয়ে গেল? সম্ভব। সর্বত্রই তো ‘মৌলবাদী ইসলামের বিরোধিতা’কে রাজনীতির ভাষা মাত্র কয়েক মুহূর্তে ‘ইসলামের বিরোধিতা’য় পরিণত করতে পারে, মানুষকে ধর্মদ্রোহিতার জুজুতে কাবু করতে পারে। এই ফাঁদে প্রায় সব ইসলাম-অধ্যুষিত দেশই অবধারিত ভাবে পা হড়কায়। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম ঘটে না।
সুতরাং ভয়টা চেপে রাখা যাচ্ছে না। তবে কি লাখ লাখ মানুষের রূপকথার এই আন্দোলন ব্যর্থ হবে? অনেকেই সতর্ক করছিলেন বটে, বারণ করছিলেন বটে মৌলবাদ-বিরোধী ধুয়ো না তুলতে... তবে কি সেটাই শোনা উচিত ছিল? হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, আওয়ামি লিগের সরকার টুকটাক করে অনেকগুলি প্রগতিশীল সংস্কারের কাজ করছিল, শত্রুসম্পত্তি প্রত্যাহার বিল পাশ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু অনেকগুলি বিতর্কিত কাজ শুরু করতে পেরেছিল। তা হলে কি ‘ফাঁসি চাই’-এর সঙ্গে ‘জামাত নিষিদ্ধ করো’ আওয়াজ না তোলাই সঙ্গত ছিল?
প্রসঙ্গত, ফাঁসি নামক শাস্তিটি সমর্থন করা শক্ত, কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে এই দাবির গুরুত্ব অন্য রকম। দুটি প্রবল যুযুধান পক্ষের সংগ্রাম-মঞ্চ, মৌলবাদ ও মৌলবাদ-বিরোধীদের ‘প্রক্সি-ওয়র’-এর প্ল্যাটফর্ম হিসেবেই একে দেখতে হবে। এ এক আশ্চর্য পরিস্থিতি যেখানে ‘ফাঁসি চাই না’ বলার প্রয়োজনীয়তার আগে বেশি জরুরি, যারা ফাঁসি চায় তাদের হাত শক্ত করা। একই কারণে, ‘ফাঁসি চাই’ দাবি থেকে ‘জামাত নিষিদ্ধ করো’ দাবি বেশি দূরের পথ নয়। জন-আন্দোলনে নেমে প্রথম দাবি থেকে দ্বিতীয় দাবিতে পৌঁছে যাওয়াটাও তাই স্বাভাবিক। এটা মনে রেখেই আগের প্রশ্নে ফেরা যাক: এই আন্দোলন কি ভুল পদক্ষেপ ছিল?
আমি মনে করি, বাংলাদেশের ইতিহাস খেয়ালে রাখলে এ প্রশ্নের উত্তর: না! যা হয়েছে ভাল হয়েছে, কারণ তা হওয়ারই ছিল। যা হবে, তার মোকাবিলা করতে হবে। সে কথা না ভেবে নিশ্চয়ই এগোননি শাহবাগের মানুষেরা, রাজশাহী-পাবনার আন্দোলকারীরা। নিশ্চয়ই জানতেন, এটা মুক্তিযুদ্ধ পর্ব ২। এ যুদ্ধ লড়তে হবে। দেশের মধ্যে যে জামাত-এর বিরুদ্ধে এতটা ক্ষোভ পুঞ্জীভূত রয়েছে, বিন্দু বিন্দু করে এতখানি প্রতিবাদের সাহস চুঁইয়ে এসে জমাট বেঁধেছে, বাংলাদেশও তা জানত না। নবীন গণতন্ত্রের পরিসরের মধ্যেও কিন্তু বোঝা যায়নি দেশের প্রগতিশীল, ধর্ম-সহনশীল, ভাষা-গরবিনি এই মুখচ্ছবিটিকে নিয়ে নতুন প্রজন্মের মধ্যে কতখানি আবেগ টলটল করছে। এই আবেগ মূলত সাংস্কৃতিক আবেগ হলেও রাজনৈতিক ইসলামের শত্রুতার সামনে পড়ে একে রাজনৈতিক রূপ গ্রহণ করতেই হত, যেমন হয়েছিল বাহান্নর ভাষা-আন্দোলনে, যেমন হয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। যে দেশে রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষায়তনও অবস্থাচক্রে রাজনৈতিক দমনের লক্ষ্য হয়ে ওঠে, ‘ছায়ানট’-এর সঙ্গীতশিক্ষকদের নাম উঠে যায় মৌলবাদী ‘হিট-লিস্টে’, বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিস্ফোরণ ঘটে, হতাহত হয় ছোট-ছোট গান-গাইয়েরা: আজ সেই সংস্কৃতি-রাজনীতিরই কঠিন পরীক্ষা। এই পরীক্ষা এক দিন না এক দিন বাংলাদেশকে দিতেই হত। এক দিকে বাঙালির সহিষ্ণু ইসলাম, অন্য দিকে অসহিষ্ণু প্যান-ইসলামি মৌলবাদের সংঘর্ষের বহ্নিশিখা শতবর্ষ ধরে পূর্ববঙ্গে ধুকপুক করে জ্বলছে। তাকে নিবিয়ে দেওয়ার চেষ্টা কম হয়নি। পনেরো বছর আগে-দেখা একটি দেওয়াল-লিখন এখনও দুঃস্বপ্নে ধাক্কা মারে: “উনিশশো একাত্তর বিরাট ভুল, ভুল সংশোধন করো।” কিন্তু সব কিছুর মধ্যেও সেই শিখা আবারও হোমাগ্নি হয়ে জ্বলে উঠবে, এই প্রতীক্ষাতেই দশকের পর দশক ধরে একুশে ফেব্রুয়ারি থরোথরো যত্নে পালিত হয়ে আসছে, ‘পহেলা বসন্তে’ লাল আবিরের থালা নিয়ে উদ্ভাসিত তরুণ-তরুণীরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ছে। এক দিন উগ্রবাদের সঙ্গে যুদ্ধ হবে, সেই প্রতীক্ষাতেই সহনশীল সংস্কৃতির পরিসরটুকু বাংলাদেশ অনেক রক্তে, অনেক মূল্যে রক্ষা করেছে, পর-প্রজন্মের মধ্যে চারিত করেছে। আজ সেই যুদ্ধের দিন। পরাজয় হতে পারে, কিন্তু এই যুদ্ধ অবধারিত। শাহবাগ নিমিত্তমাত্র।
আর এ পর্যন্ত পৌঁছেই আমরা বুঝতে পারি: আরব বসন্তের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনাই চলে না। টিউনিসিয়া থেকে লিবিয়া থেকে মিশর থেকে সিরিয়া, সব ক’টি দেশের মানুষই রাস্তায় নেমে এসেছিলেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে। অসহিষ্ণু সমাজের বিরুদ্ধে নয়। তাঁরা গণতন্ত্র চেয়েছিলেন, কিন্তু মৌলবাদ স্বীকার করতে আপত্তি করেননি।
কিংবা আর-এক শিশু গণতন্ত্রের দেশ পাকিস্তানের কথা যদি ভাবি? যেখানে অসহিষ্ণু মৌলবাদের হাত শক্ত করে ধরে থাকে গণতান্ত্রিক সরকার, সেই অশুভ-অক্ষের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজ অদ্যাবধি একটি প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-মিছিল-আন্দোলনও আয়োজন করতে পারে না? সেই পাকিস্তানকে আজ বাংলাদেশ বরং দেখিয়ে দিক, লাভ-ক্ষতি জয়-পরাজয় তুচ্ছ করে অসহিষ্ণু মৌলবাদের সঙ্গে লড়বার শক্তি কী ভাবে সংগ্রহ করতে হয়, কী ভাবে যথার্থ নেতৃত্ব পেলে সাধারণ মানুষই তৈরি করে ফেলতে পারেন মহাকাব্যিক মুহূর্ত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.