বহু শিল্প ফাঁসিকে বলিয়াছে রাষ্ট্রকৃত হত্যা। হত্যাকারীকে ফাঁসি প্রদানের অর্থ: সে যাহা করিয়াছে, হুবহু সেই হীন কাজটিই করা, কেবল এই বার তাহা রাষ্ট্রের পক্ষে করা হইতেছে বলিয়া ‘ন্যায়বিচার’ নাম দিয়া শ্লাঘা উদ্যাপন। এই মতের সমর্থনে বহু তত্ত্ব বলা হইয়াছে, বিপক্ষেও। মৃত্যুদণ্ড ব্যাপারটিই যুগে যুগে প্রবল বিতর্কের জন্ম দিয়াছে, ক্ষমতা ক্ষমা ও অধিকার লইয়া ফুটন্ত আলোচনা চিন্তা-পরিবেশ উত্তপ্ত করিয়াছে। সাম্প্রতিক দিল্লি ধর্ষণ-কাণ্ডে অধিকাংশ মানুষ অপরাধীদের চূড়ান্ত দণ্ড দানের সমর্থক ছিলেন, বাংলাদেশে অপরাধী রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে অধিকাংশ আন্দোলনকারী উত্তাল। কিন্তু চিন চার জন মৃত্যুদণ্ডিতকে লইয়া যাহা করিল, তাহা হজম করিতে প্রতিহিংসার আইনি প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসী মানুষেরও কিঞ্চিৎ ঝঞ্ঝাট ঘটিবে। সমগ্র বিশ্বের নিরিখে বৎসরে সর্বাধিক মৃতু্যুদণ্ড প্রদান করা হয় চিনে। সেই ধারা মানিয়াই, মাদক পাচার ও পনেরো জন চিনা নাবিককে হত্যায় অভিযুক্ত চার ব্যক্তিকে গত শুক্রবার মারণ-ইঞ্জেকশন দিয়া মারা হইল। কিন্তু তাহার পূর্বে, জেলের কুঠুরি হইতে মৃত্যুকক্ষ অবধি তাহাদের লইয়া যাওয়ার গোটা সময়টিই সরাসরি সম্প্রচার করা হইল সরকারি দূরদর্শনে। তাহাদের অন্তিম যাত্রাটি গণমাধ্যমের সম্মুখে, অর্থাৎ সম্ভাব্য অসংখ্য মানুষের সম্মুখে, সংগঠিত করিবার উদ্দেশ্য সম্ভবত অপরাধপ্রবণতা হ্রাস করা। অথবা চিন তাহার শত্রুদের প্রতি কী পরিমাণ নির্মম তাহা দর্শাইয়া দেশপ্রেম বৃদ্ধি। বৃদ্ধি পাইয়াছে অবশ্য মানুষের নিন্দা, অস্বস্তিও। |
আধুনিক বিশ্বে, চরম পরিস্থিতিতেও মানবিকতার প্রতি কিঞ্চিৎ ঝুঁকিয়া থাকিবার একটি চল হইয়াছে। সেই দস্তুর মর্দিত করিয়া চিন স্পর্ধিত ‘রিয়েলিটি শো’-টি ঘটাইল। সহস্র ক্যামেরা-ফ্ল্যাশের মধ্য দিয়া মানুষগুলিকে লইয়া যাওয়া হইল, যেন তাহারা তারকা, বা চিড়িয়াখানায় আনীত উদ্ভট জন্তু। তাহাদের মুখে স্পষ্ট ভীতি, বা যথেষ্ট ভীতির অভাব, কোটি দর্শকের কৌতূহল ও জল্পনার বিষয় হইল। বহু কাল পূর্বে মৃত্যুদণ্ড বা পাথর ছুড়িয়া হত্যা সর্ব দেশেই জন-আকর্ষক ঘটনা ছিল, এখনও বহু রাষ্ট্রে প্রকাশ্যে অপরাধীর শিরশ্ছেদ করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ অঞ্চলে গৃহীত সভ্যতার সংজ্ঞায়: চরম ন্যক্কারজনক অপরাধীরও কিছু অধিকার রহিয়াছে, কিছু সম্মান ও সুব্যবহার তাহার প্রাপ্য। মৃত্যুপথযাত্রীর প্রতি সমবেদনা ও মৃতের প্রতি সম্মান প্রায় সকল সংস্কৃতিরই অঙ্গ। যে মানুষটিকে হাত বাঁধিয়া তাহার নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে টানিয়া লইয়া যাওয়া হইতেছে, তাহার প্রতি হন্তারক রাষ্ট্র অন্তত এইটুকু দায়বদ্ধ: এই মৃত্যু একটি গুরু ও বিমর্ষ ঘটনার মর্যাদা পাইবে, লঘুতা আরোপ করিয়া ইহাকে চরম অসম্মান করা হইবে না। নিজ নিধনের প্রতি হাঁটিয়া যাইবার সময় তাহাকে নিজ চিন্তায় ডুবিয়া থাকিবার পরিসরটুকু দেওয়া হইবে। অথবা নিজ আর্তনাদ করিয়া উঠিবার। তাহাকে সম্প্রচারের বিষয় করিয়া তাহার অন্তিম মুহূর্তগুলিকেও অসহ রূপে ব্যাহত করা, তাহাকে বিরক্ত ও উত্তেজিত করিয়া ওই মহামূল্যবান সময়টুকুও নিজতার অবকাশ হইতে বঞ্চিত করা এবং তাহাকে জানানো যে তোমার তীব্রতম বিষাদকেও অপমান করিয়া তোমাকে লইয়া তামাশা বসাইতেছিএই ধর্ষণাধিকার কাহারও নাই। দণ্ডিতকে দেখিয়া দণ্ডদাতা হাসে যবে, সর্বনিম্ন সে বিচার। মৃত্যু-প্রক্রিয়াটিকে চিন সরাসরি দেখায় নাই অবশ্য। নিশ্চয় এমন দিন দূরে নাই, যখন কোনও রাষ্ট্র সেটিও সারিয়া টিআরপি-সেবক যুগের পরম ফায়দা লুটিবে। মানবাধিকার সেই দিন প্রকৃত ফাঁসিতে চড়িবে। |