সরকারি স্কুলের মধ্যেই মদ-মাংসের আসর বসানোয় গ্রেফতার হলেন তৃণমূলের এক শিক্ষক নেতা ও তাঁর দুই অনুগামী। কোচবিহারের দেড়শো বছরের পুরনো বিখ্যাত জেনকিন্সে স্কুলের শিক্ষকদের বসার ঘরে বৃহস্পতিবার রাতে ওই আসর বসানো হয়েছিল। ধৃত বিজন সাহা তৃণমূলের সরকারি স্কুল শিক্ষকদের সংগঠনের রাজ্য সভাপতি। তিনি জেনকিন্সে অঙ্ক শেখান। দিলীপ রায় নামে ওই স্কুলের আর এক অঙ্কের শিক্ষকও গ্রেফতার হয়েছেন। ধরা হয়েছে পীযূষ সরকার নামে ওই স্কুলের এক শিক্ষাকর্মীকেও। শুক্রবার তাঁরা সকলেই থানা থেকে জামিন পেয়ে গিয়েছেন। তবে পুলিশের দাবি, সকলের মুখেই মদের গন্ধ মিলেছে। অস্বস্তির মুখে পড়ে দলীয় পর্যায়ে ঘটনার তদন্ত শুরুর নির্দেশ দিয়েছেন তৃণমূলের উত্তরবঙ্গের কোর কমিটির চেয়ারম্যান গৌতম দেব। স্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি তথা কোচবিহারের জেলাশাসক মোহন গাঁধীও বলেছেন, “অভিযোগ গুরুতর। বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি।” |
বছর সাতেক হল বিজনবাবু দেড়শো বছরের পুরনো এই ঐতিহ্যশালী স্কুলে চাকরি পেয়েছেন। সম্প্রতি রাজ্যে পালাবদলের পরে তিনি তৃণমূলের ওই শিক্ষক সংগঠনের নেতা হন। স্কুলে তাঁর দাপটও বাড়তে থাকে। কোচবিহারে ছাত্র পরিষদের নেতা রাকেশ চৌধুরী বলেন, “শাসক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থেকেই ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠছিলেন বিজনবাবু। সেই কারণেই এই সুপ্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বসেই মদ্যপান করার দুঃসাহসও দেখাতে পারলেন তিনি।” তবে বিজনবাবুর দাবি তিনি স্কুলের উন্নতির জন্য নানা চেষ্টা করছেন, সে কারণেই ঈর্ষাণ্বিত হয়ে কেউ কেউ ষড়যন্ত্র করেছেন। তাঁর কথায়, “তদন্ত হোক, তা হলেই সব স্পষ্ট হবে।” তা হলে, ওই দিন সন্ধ্যায় ঘর থেকে যে ৪টি ফাঁকা মদের বোতল পাওয়া গিয়েছে, তা থেকে কারা মদ খেয়েছেন? ঘরময় কাজু-কিসমিস, চানাচুর, মাংসের হাড়ই বা ছড়িয়ে ছিল কেন? তাঁদের মুখ থেকে মদের গন্ধই বা পাওয়া গেল কেন? সব ক’টি প্রশ্নের জবাবে বিজনবাবুর একটাই উত্তর, “সব ষড়যন্ত্র।” |
প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জেনেছে, ওই দিন সন্ধ্যার পরে স্কুলের স্টাফ রুমে লোকজন দেখে এলাকার লোকজন ভেবেছিলেন, মাধ্যমিক চলছে বলেই হয়তো কোনও কাজকর্ম হচ্ছে। কিছু ক্ষণ পরে মাংস রান্নার গন্ধ পেয়ে সন্দেহ হয়। এলাকার কয়েকজন উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখতে পান, স্টাফ রুমে জমিয়ে বসেছে মদের আসর। মিড ডে মিলের রান্নাঘর থেকে ঘনঘন সেখানে যাচ্ছে গরম বেগুনি, কাজু-কিসমিস, শসা, চানাচুর। ভিতরে সকলের হাতে মদ ভর্তি গ্লাস। সে খবর ছড়িয়ে পড়ে চার দিকে। বাইরে ভিড় জমছে বুঝতে পেরেই তড়িঘড়ি ডাল-ভাত-মাংস খেয়ে সাইকেল, স্কুটার নিয়ে অনেকেই সরে পড়েন। কিন্তু বিজনবাবু ও তাঁর দুই সঙ্গী তখনও স্টাফ রুমের আসরে বসে। ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁদের ঘিরে ধরে বিক্ষোভ শুরু করেন। অভিযোগ, বিজনবাবু তখন একাধিক তৃণমূলের বিধায়ক, মন্ত্রীর নাম করে সকলকে দেখে নেওয়ার ‘হুমকি’ দেন। মারপিটের উপক্রম হলে পুলিশ গিয়ে বিজনবাবু সহ ৩ জনকে থানায় নিয়ে যায়। পুলিশ সূত্রের খবর, সেখানেও সকলকে ‘শাসাতে’ থাকেন বিজনবাবু। পরে পুলিশ তিন জনকে গ্রেফতার করে লক আপে ঢুকিয়ে দিলে তাঁরা চুপ করেন। জেনকিন্স স্কুলের প্রধান শিক্ষক কার্তিক পাত্র এখন ছুটিতে। সহকারী প্রধান শিক্ষক রঞ্জিত বাজপেয়ী পুরো বিষয়টি জেলাশাসক ও স্কুল শিক্ষা দফতরে জানিয়েছেন।
বিজনবাবু তুফানগঞ্জের তৃণমূল বিধায়ক অর্ঘ্য রায়প্রধানের ঘনিষ্ঠ বলে দলীয় মহলে পরিচিত। অর্ঘ্যবাবুর কিন্তু সোজা কথা, “কারা এ সব বলছেন জানি না। আমার ঘনিষ্ঠ বলে কেউ নেই। আইন আইনের পথে চলবে।” তৃণমূল জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষও বিজনবাবুর দায়িত্ব নিতে নারাজ। এলাকার মানুষের অবশ্য ক্ষোভ জেনকিন্স স্কুলের নামে কালি লাগার জন্য। স্কুলের প্রতিষ্ঠা ১৮৬১ সালে। বরাবর ভাল ফল করার জন্য সুখ্যাত। কংগ্রেস নেত্রী অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা সবিতা রায় বলেন, “এই স্কুল কোচবিহারের গর্ব। সারা রাজ্যে তার সুনাম রয়েছে। সেই স্কুলের ঐতিহ্য যারা এ ভাবে নষ্ট করেছেন, তাঁদের ক্ষমা করা অনুচিত।” |