কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটিতে নিজস্ব ভোট ব্যাঙ্ক তৈরি করতে পেরে খুশি তৃণমূল নেতৃত্ব। আবার তৃণমূলের ক্রাচে ভর দিয়ে নয়, বরং উপনির্বাচনে বামেদের পাশাপাশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের বিরুদ্ধেও লড়াই করে যে ফল হয়েছে, তাতে উৎসাহিত কংগ্রেস। কিন্তু এর মধ্যেই নলহাটির ফল প্রাক্তন দুই জোটসঙ্গীর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, কংগ্রেস-তৃণমূলের লড়াইয়ের জেরে বামেরা কী ভাবে অক্সিজেন পাচ্ছে। দু’দলের অন্দরেই প্রশ্ন, এ ভাবে চললে কার লাভ? আগামী লোকসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে বাম-বিরোধী দুই শিবিরেই নানা সম্ভাবনা তাই উঁকি দিতে শুরু করেছে।
ভবিষ্যতে তাঁরা ফের হাত ধরবেন কি না, তা নিয়ে তৃণমূলের মুকুল রায় থেকে কংগ্রেসের প্রদীপ ভট্টাচার্য, কেউই এখন সুনির্দিষ্ট কোনও উত্তর দেওয়ার জায়গায় নেই। মুকুল বলেছেন, “আগামী দিনে রাজনীতি কী হবে, তা এখনই বলতে পারি না।” প্রদীপবাবুরও বক্তব্য, “রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু হয় না!” দু’দলের নেতা-কর্মীদের অনেকেই মনে করেন, মুর্শিদাবাদের রেজিনগর কংগ্রেস দখলে রাখতে পেরেছে অধীর চৌধুরীর ব্যক্তিগত প্রভাবের জোরেই। আর মালদহের ইংরেজবাজার কংগ্রেসের হাত থেকে তৃণমূল ছিনিয়ে নিতে পেরেছে কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরীর ‘ক্যারিশমা’য়। কিন্তু বীরভূমের নলহাটিতে কংগ্রেসের যেমন কোনও অধীর নেই, তেমনই তৃণমূলেরও কোনও কৃষ্ণেন্দু নেই। সেখানে রাজনৈতিক সমীকরণই কাজ করেছে, যার জেরে জিতেছে ফরওয়ার্ড ব্লক! প্রকাশ্যে মুখ না-খুললেও কংগ্রেস-তৃণমূলের অনেকেই বলছেন, “আমাদের দু’দলের ভোট যোগ করলে ফরওয়ার্ড ব্লক তো হাওয়া হয়ে যায়!”
আর এটাই ভাবাচ্ছে কংগ্রেস-তৃণমূলকে। এ বারের উপনির্বাচনে তিন কেন্দ্রেই বামেদের ভোট কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। মুকুলের মতো তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের ব্যাখ্যা, তাঁদের কুড়ি মাসের সরকারের বিরুদ্ধে নানা ‘অপপ্রচার’ করেও বামেরা নিজেদের ভোট ব্যাঙ্ক সারাই করে উঠতে পারেনি। কংগ্রেস ও তৃণমূলের ভোট কাটাকুটিই তাদের ভরসা। তা হলে তৃণমূল এখন কী করবে? মুকুলের জবাব, “এটা ভবিষ্যতের ব্যাপার।” উপনির্বাচনের মিশ্র ফলে বাম-বিরোধী জনতার বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে মুকুল বলেন, “মানুষ এ বারের ভোট থেকে শিক্ষা নেবে। আগামী দিনে মেরুকরণ হয়ে যাবে।”
উপনির্বাচনের পরে তৃণমূলের অন্দরে এখন নানা জল্পনা। একদা জোটসঙ্গী বিজেপি-র হাত মমতা আবার ধরবেন কি না, সেটা এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। আবার দলের অনেকেই মনে করেন, সংখ্যালঘুদের মন পেতে তৃণমূল সরকার যে সমস্ত পদক্ষেপ করেছে, বিজেপির হাত ধরে তার প্রভাব নষ্ট হোক, তা কখনওই চাইবেন না মমতা। উপনির্বাচনে নলহাটি ছাড়া বাকি দুই কেন্দ্রেই বিজেপি-র ভোট যথেষ্ট কমেছে। তার উপরে রাজ্যের উন্নয়নের প্রশ্নে বারবার গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নাম ওঠায় চটে আছেন মমতা। সেই মোদীকে সামনে রেখে বিজেপি আগামী লোকসভা ভোটে লড়লে, তাদের সঙ্গে হাত মেলানোর প্রশ্ন প্রায় নেই-ই বলে তৃণমূলের বড় অংশের ধারণা। তা হলে কি শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের হাতই ধরবে তারা? তৃণমূলের নেতাদের অনেকেই আশায়, ফের জোটের বল গড়াবে। তাঁদের কথায়, “বাজেটের পরে দিদি কিন্তু কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তোপ দাগেননি। উপনির্বাচনের ফল নিয়ে কোনও উচ্ছ্বাসও দেখাননি।” এ সব ভবিষ্যতে কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব মেটানোর ইঙ্গিত বলেই তাঁরা মনে করেন।
অন্য দিকে, পঞ্চায়েত ভোটের আগে উপনির্বাচনের ফল তাঁদের মনোবল বাড়াবে বলেই মনে করছেন মানস ভুঁইয়া, অধীর চৌধুরী, দীপা দাশমুন্সিরা। জোট ভাঙার পরে গত ছ’মাসে তৃণমূলের সরকারের বিরুদ্ধে রাজ্যে আন্দোলন করেছে কংগ্রেস। তারই সুফল উপনির্বাচনে মিলেছে বলে মনে করছেন প্রদেশ নেতৃত্ব। এই পরিপ্রেক্ষিতেই কংগ্রেস নেতারা মনে করেন, কুড়ি মাসের তৃণমূল-সরকারের প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ভোটের একটা বড় অংশ তাঁরা পেয়েছেন। মানসবাবুর দাবি, উপনির্বাচনের ফল দলকে নতুন দিশা দেখিয়েছে। দীপার কথায়, “অনেক দিন পরে কংগ্রেস নিজস্ব জায়গা খুঁজে পেয়েছে।” রাজ্যে কংগ্রেসকে আরও প্রাসঙ্গিক এবং সাংগঠনিক দিক থেকে মজবুত করে তুলতে এই পরিস্থিতি পুরো দমে কাজে লাগানো উচিত বলে মনে করছেন কংগ্রেস নেতৃত্বের একাংশ।
পাশাপাশি, নিজেরা আলাদা লড়ে ঘুরপথে বামেদের সাহায্য করার পরিস্থিতি বজায় রাখা যে ঠিক হবে না, তা-ও বুঝতে পারছেন কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশ। জোটের প্রশ্নে শুক্রবার দিল্লিতে অধীরের সতর্ক বক্তব্য, “আমরা কিন্তু জোট ভাঙিনি! তৃণমূলই জোট ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে। এখন তারা কী করবে, তা ভবিষ্যতের ব্যাপার।”
অঙ্ক, পাল্টা অঙ্কের স্রোত। ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগে কি না, তা নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে। |