কাট ওয়ান: বেলা দু’টো এখন। বাইশ গজের চার দিক ঘিরে চার-পাঁচ জন মাঠকর্মী। এক মিনিট দম ফেলার উপায় নেই, যতটুকু যা ঘাস আছে উড়িয়ে ফেলতে হবে। একটু দূরে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে কিউরেটর ওয়াই চন্দ্রশেখর। পিচে জল দেওয়া বন্ধ। শুকনো, খটখটে একটা আদল। অতীতের দিকপাল স্পিনার শিবলাল যাদব ঘুরে যাচ্ছেন মাঝে-মধ্যে। সচিন, ধোনির সঙ্গে একপ্রস্ত কথা হল। সচিন তো আবার পিচের ধারে উবু হয়ে বসে সব দেখেও নিলেন!
বধ্যভূমি প্রস্তুতির বহর দেখলে কানে বাজবে মাইকেল ক্লার্কের অসহায় গলা। কিছুক্ষণ আগেই অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক বলে গিয়েছেন না, “গতকাল উইকেট দেখে মনে হয়েছিল তৃতীয় বা চতুর্থ দিনের পিচ দেখছি। টেস্ট যত এগোবে, উইকেট তত ভাঙবে...।”
ক্লার্ক বলছেন বটে, কিন্তু শুনছে কে? উল্টে সব শুনে কিউরেটরের নির্লিপ্ত উত্তর, “হোম টিম যেমন চাইবে, তেমনই দিতে হবে। ওদের দেশে অশ্বিনদের কথা ভেবে পিচ তৈরি হয়?”
কাট টু: ফিল্ডিং সেশন শেষ করে নেটে ঢুকছেন সর্দার। বল হাতে নিলেন কি নিলেন না, নেটের ভেতর থেকে তড়িঘড়ি বেরিয়ে এলেন তিনি। মানে, সচিন তেন্ডুলকর। কী ব্যাপার? রান আপটা ঠিক করা চাই। আর বাধ্য ছাত্রের মতো সম্মতির ঘাড় নেড়ে চলেছেন যিনি? হরভজন সিংহ! চেন্নাইয়ে যিনি সেঞ্চুরি টেস্ট খেলে এসেছেন। উইকেট চারশোর কোটা পেরিয়ে গিয়েছে। |
ইশান্ত শর্মাও রেহাই পেলেন না। যত দিন যাচ্ছে বারোটা নয়, তাঁর সাড়ে বারোটা বাজছে। অতএব, ডাকো ইশান্তকে। ডেকে বুঝিয়ে দাও, বল কতটা ভেতরে আনলে উইকেট আসবে। শেষে বসল প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা। পরীক্ষক কে? কেন তিনিক্রিকেটের চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া!
দেখে ধন্ধ লাগবে। মনে প্রশ্ন উঠবে, টিম ইন্ডিয়ার আসল ‘ক্যাপ্টেন’ তা হলে কে? লালমুখো সাহেব কোচের কাজটাও বা ঠিক কী? স্টেডিয়ামের সিংহদরজার ঠিক বাইরে আবার ততক্ষণে এক শিল্পীকে নিয়ে মিডিয়ার ধস্তাধস্তি। হাতে সচিনের অনিন্দ্যসুন্দর পেনসিল স্কেচ। লিটল মাস্টারের জন্য উপহার।
ঘণ্টাদু’য়েক এ পিঠ-ও পিঠের দু’টো ছবি। টিম ইন্ডিয়ার মননের সারমর্ম কিছুটা পরিষ্কার হল নাকি? এক দিকে ‘অর্ডারি’ পিচ তৈরি চলছে। যেখানে নিশ্চিন্তে লেলিয়ে দেওয়া যাবে রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে। যাঁর টেস্টের সেরা বোলিং (১২-৮৫) এই উপ্পলে, গত বছর। অন্য দিকে ব্যাগি গ্রিনের ঔদ্ধত্যকে স্তব্ধ করতে বাড়তি উদ্যম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া টিমের ‘বড়দা’ব্যস, ভারত অধিনায়কের আর চিন্তা কীসের?
আদতে ভুল। ঘটনা হচ্ছে, যত না স্বস্তি আছে ধোনির ভারতে, তার চেয়ে শঙ্কা বেশি। ‘ডিজাইনার’ পিচেও যা গলায় বিঁধছে কাঁটার মতো। খুব সহজে, শনিবার থেকে হায়দরাবাদ টেস্টে এমএসডি-র প্রতিপক্ষের সংখ্যা দুই। অস্ট্রেলিয়া যেমন, নিজ-টিমের সমস্যা তেমন। যা এক নয়, একগুচ্ছ।
চশমা পরা সহবাগের ব্যাটের সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে? প্যাটিনসনের গতি সামলাতে পারবেন মুরলী বিজয়? ইশান্তকে পাঁচ ওভারের বেশি দেওয়া যাবে? স্পিন-কম্বিনেশনে ফিরবে ভারসাম্য?
ইশান্তের বর্তমান অবস্থা কী, আগেই বলা হয়েছে। প্রস্তুতিপর্বকে সূচক ধরলে, উপরোক্ত বাকি দুইয়ের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। নেটে বীরুর যেটা লাগল সেটা উড়ল, যেটা লাগল না, উইকেটের কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। আর আজ প্যাটিনসনকে দরকার পড়েনি। শুক্রবার নেটে অশোক দিন্দার গতির সামনেই যা অবস্থা বিজয়ের, তাতে প্রশ্ন উঠতেই পারে ইশান্ত এখনও কী করছেন? অশ্বিন নিজেই বাস্তবের রুক্ষ জমিতে ২-০-র সুখস্বপ্নকে আরও আছড়ে ফেললেন। চেন্নাই-উত্তর ভারত অধিনায়ক তাঁকে বলেছেন, ২২৪ একদিনই হবে। জীবনে আর হবে কিনা সন্দেহ! চিপকে ধোনির ইনিংস বাদ দিলে কী হতে পারত সেটা যেমন সবাই জানেন, তেমনই সচিন-ধোনি আটকে গেলে কী হতে পারে বুঝতে ক্রিকেটটা না খেললেও চলবে। টপ অর্ডারের যা ‘ধারাবাহিকতা’! তার ওপর ঘরের ছেলে প্রজ্ঞান ওঝাকে খেলানো নিয়ে চোরা অশান্তি। উইনিং কম্বিনেশন ধোনি ভাঙবেন কি না, ঠিক নেই। এক জন পেসার কমিয়ে বা ইদানীং যাঁর সিংহগর্জন প্রায় অবলুপ্তির পথে, সেই হরভজনকে বসিয়ে ওঝাকে খেলানোটা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু যুক্তির অত ধার ধারবেন ধোনি? ক্লার্ক কিন্তু শুনিয়ে গেলেন এই পিচে ওঝা সমেত ভারতকে না দেখলে তিনি নাকি বেশ অবাকই হবেন! |
যদিও তাঁর পৃথিবীই ক্লার্ককে অবাক করবে বেশি। ’৮৬-র অ্যালান বর্ডারের টিমের পর ভারত সফরে এত অনভিজ্ঞ অস্ট্রেলিয়া টিম বিশেষ দেখা যায়নি। সচিন-সহবাগ, বা সচিন-হরভজন মিলে যত টেস্ট খেলেছেন, মাইকেল ক্লার্কের গোটা অস্ট্রেলিয়া তার চেয়ে কম খেলেছে! সম্মিলিত অভিজ্ঞতার ঝুলিতে মাত্র ২৫৫ টেস্ট, যার মধ্যে ক্লার্কেরই ৯১! তবু চেষ্টা হচ্ছে, ইংরেজ-দাওয়াইয়ে ইন্ডিয়াকে মারার। মুখে স্বীকার করতে ক্লার্কের গায়ে লাগছে, তবে লিয়ঁর সঙ্গে ডোহার্টিকে না জুড়লে মুশকিল আছে তিনি জানেন। তবে তাতেও লাভ খুব হবে কি? ডোহার্টি আর মন্টি পানেসর এক নন, লিয়ঁর সঙ্গেও সোয়ানের তুলনা চলে না। তার উপর এ দিন আবার থ্রো-ডাউন নেওয়ার সময় থুতনিতে বল লেগে হাড় ভেঙেছে উইকেটকিপার ম্যাথু ওয়েডের। তিনি অনিশ্চিত। সিরিজ কভার করতে আসা অস্ট্রেলীয় সাংবাদিকদের কেউ কেউ বলেও ফেলছেন, বর্ডারের মতো ক্লার্কের সিরিজ ড্র রেখে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা ইশান্ত শর্মার দেহসৌষ্ঠবের মতো। এতটাই নাকি লিকলিকে!
শেষ দুপুরের ক্লার্ককে দেখলে তাই খারাপ লাগে। মাঠে একা একা শ্যাডো করে চলেছেন। ভিস্যুয়ালাইজ করছেন নিজের ইনিংস। এক সময় ম্যাথু হেডেন করতেন। কিন্তু স্টিভ বা পন্টিংয়ের ‘সুপার সেভেন’-এর এক জন ছিলেন হেডেন। সেখানে ক্লার্ক নিঃসঙ্গ। না আছে তাঁর পকেটে অর্ডারি পিচ, না আছে সচিনের মতো ‘বড়দা’। তাই খারাপ লাগে যখন বলে ফেলেন, “জানি ফিরে আসতে গেলে আমাকে ভাল খেলতেই হবে।” ঠিকই। বর্তমান ভারত সফরে তিনিই নিউক্লিয়াস, তিনিই ব্যাগি গ্রিনের একমাত্র রক্ষাকবচ।
চাপটাও যে দৈত্যাকৃতির ‘হেডেন-সম’ হবে, সন্দেহ কী?
|