পশ্চিমবঙ্গের তিনটি বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনের ফলাফলে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস ও বামপন্থী প্রত্যেকেই একটি করিয়া আসন লাভ করায় আপাতদৃষ্টিতে রাজ্য-রাজনীতির তিন প্রধান কুশীলবই খুশি, এমন একটা সরলীকরণে পৌঁছানো সহজ। বাস্তবে কিন্তু কিছুটা খুশি হওয়ার কারণ একা কংগ্রেসেরই রহিয়াছে। কারণ এই দল প্রমাণ করিয়া দিয়াছে, শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গত্যাগ ও প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও রাজ্যে তাহার ভোটাররা তাহাকে ছাড়িয়া যায় নাই। উপরন্তু বামপন্থীদের ছাড়িয়া যাওয়া জনসমর্থন তৃণমূল কংগ্রেস অপেক্ষাও তাহার দিকেই অধিকতর ঝুঁকিয়াছে। তিনটি আসনেই দলের প্রাপ্ত ভোটে তাহার ইঙ্গিত আছে। রাজ্যে বাম-বিরোধী রাজনীতির সমাবেশবিন্দু হইয়া থাকিতে গেলে যে কংগ্রেসের সাহচর্যও তৃণমূল কংগ্রেসের দরকার, এই সত্যটিও নূতন করিয়া সামনে আসিয়াছে।
তবে এই উপনির্বাচনের ফলাফল যে বিষয়টির দিকে মূলত অঙ্গুলিনির্দেশ করে, তাহা হইল রাজ্য-রাজনীতিতে বামপন্থীদের ক্রমান্বয়ে শক্তিক্ষয়। বীরভূমের নলহাটি আসনটিতে ফরওয়ার্ড ব্লকের জয় যে কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট-কাটাকাটির ফল, তাহা পরিষ্কার। অন্য দুই আসনের মতো বামেদের জেতা এই আসনেও বাম ভোট উল্লেখযোগ্য ভাবে (গড়ে ১০ হাজারেরও বেশি করিয়া) হ্রাস পাইয়াছে। অস্যার্থ, বামেদের মলিন ভাবমূর্তি গত কুড়ি মাসে উজ্জ্বল হয় নাই। অন্য ভাবে বলা যায়, জনসাধারণ বাম জমানার বিরূপ অভিজ্ঞতা ও অপশাসনের স্মৃতি দূরে সরাইয়া এখনই বামপন্থীদের পুনরামন্ত্রণে প্রস্তুত নহেন। অদূরবর্তী পঞ্চায়েত নির্বাচনেও এই ধারা বজায় থাকে কি না, তাহা ক্রমশ প্রকাশ্য।
হয়তো তাহার কোনও সঙ্গত কারণও নাই। ২০১১-র বিধানসভা ভোটের পর এমন কিছু ঘটে নাই, যাহা বামেদের প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানাইবার ক্ষেত্র প্রস্তুত করিবে। যদি কখনও তেমন পরিস্থিতি বা সম্ভাবনার উদয় হয়, বর্তমান শাসকদের শাসনপ্রণালীতে বিরূপ হইয়া ভোটাররা যদি ভবিষ্যতে আবার কখনও বিকল্পের সন্ধান করে, সে ক্ষেত্রেও কি বামপন্থীরা পুনরুত্থানের জন্য প্রস্তুত হইতে পারিবেন? তাঁহাদের দলের সংগঠন, সেই সংগঠনের থাকবন্দি প্রস্তরীভূত কাঠামো, উপরতলা-নিচুতলার জটিল আন্তঃসম্পর্ক, নেতৃত্বে শিলীভূত বৃদ্ধতন্ত্রের মৌরসি পাট্টা, প্রথা-পদ্ধতি-প্রকরণের প্রতি দলের দুরপনেয় নিষ্ঠা ও অপরিমেয় আনুগত্য এই সবই দ্রুত-পরিবর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সহিত খাপ খাওয়াইয়া লওয়ার পথে মূর্তিমান প্রতিবন্ধক। সরকার ও প্রশাসনের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সহযোগিতা ছাড়া সিপিআইএম তথা বামপন্থীরা দীর্ঘ সাড়ে তিন দশক পর এ বারই প্রথম নির্বাচন লড়িলেন এবং সেই লড়াইয়ের পরিণাম চোখের সামনে। স্পষ্টতই বামেরা এখনও ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত রাজনীতিকদের দ্বারাই চালিত, বেগবান, নমনীয় নেতা বা কর্মিবাহিনী গড়িয়া তুলিবার সামর্থ্য তাহার নাই। নাই জনসাধারণকে অনুপ্রাণিত করার শক্তি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবশ্য নিশ্চিন্ত ও নিরুপদ্রব বোধ করিবার কারণ নাই। তাঁহার দল ইংলিশবাজার আসনটিতে যে সাফল্য পাইয়াছে, তাহা বহুলাংশেই সদ্য কংগ্রেসত্যাগী প্রার্থী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ও প্রভাবের কারণে। ওই প্রভাব ও জনপ্রিয়তাই কংগ্রেসের প্রথাগত দুর্গটিকে তৃণমূলের হাতে আনিয়া দিয়াছে। অন্য দুই আসনেই কিন্তু শাসক তৃণমূল কংগ্রেস তৃতীয় স্থানে, যাহা মুখ্যমন্ত্রী তথা দলের অদ্বিতীয় নেত্রীর পক্ষে আদৌ শ্লাঘনীয় নয়। কংগ্রেস যে এ রাজ্যে এখনও প্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক শক্তি, অন্তত বামবিরোধী রাজনীতির নিয়ামক হইতে গেলে যে রাজ্যে কংগ্রেসকে ব্রাত্য রাখিয়া একলা চলার জেদ ও একগুঁয়েমি রাজনৈতিক মূঢ়তা ও অবিমৃশ্যকারিতা বলিয়া গণ্য হইবে, এই জরুরি শিক্ষাটি এই উপনির্বাচনের মধ্য দিয়া স্পষ্ট হইয়াছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই শিক্ষাটি গ্রহণ করিবেন কি না, সেটা তাঁহার ব্যাপার। তবে নিজেকে, নিজের দলকে, দলের নীতি ও কর্মসূচিকে প্রায় বিনা নোটিসে আমূল পাল্টাইয়া ফেলার সুবিধা ও নমনীয়তা তাঁহার আছে। সেই দিক দিয়া তিনি বামপন্থীদের তুলনায় অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় রহিয়াছেন। |