মৌলবাদীরা যতই তাণ্ডব চালাক, বাংলাদেশ সফরে অনড় প্রণব মুখোপাধ্যায়।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে এটি তাঁর প্রথম বিদেশ সফর। বলতে গেলে তিনি নিজেই তাঁর প্রথম সফরের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু তার আগেই জামাতে ইসলামির অন্যতম শীর্ষ নেতা দেলোয়ার হোসেন সাইদিকে ঢাকার আন্তর্জাতিক আদালত একাত্তরের খুন-ধর্ষণের জন্য প্রাণদণ্ড দেওয়ায় বাংলাদেশ জুড়ে হাঙ্গামা শুরু করেছে মৌলবাদীরা। বৃহস্পতিবার কয়েক ঘণ্টার হিংসায় প্রায় ৪৭ জনের প্রাণ গিয়েছে।
রবিবার প্রণববাবুর ঢাকায় পৌঁছনোর কথা। আর ওই দিন থেকেই পরপর দু’দিন হরতাল ডেকেছে জামাতে ইসলামি। সফরের তৃতীয় ও শেষ দিন মঙ্গলবারের হরতালটি ডেকেছে বিএনপি। এই পরিস্থিতিতে তাঁর সফর কি স্থগিত থাকছে?
এ প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রপতি ভবনের মুখপাত্র বেণু রাজামণি জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি ঢাকার পরিস্থিতি জানেন। নিয়মিত খোঁজখবর নিচ্ছেন। তার পরেও তিনি বাংলাদেশে যেতে উদগ্রীব। রাষ্ট্রপতি ভবন সূত্রের খবর, প্রণববাবু মনে করেন, হাঙ্গামার ভয়ে পূর্বনির্ধারিত সফর পিছিয়ে দেওয়ার অর্থ হবে মৌলবাদীদেরই জিতিয়ে দেওয়া। বাংলাদেশের মানুষ এখন রাস্তায় নেমে একের পর এক মৌলবাদী হরতাল বানচাল করে দিচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে শুধু সফরে যাওয়াই নয়, সেই সফর কোনও রকম কাটছাঁট করতেও রাজি নন প্রণববাবু। বিদেশসচিব রঞ্জন মাথাই বলেন, “আমরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক রেখে চলেছি। ঢাকা আজ শান্ত। রাষ্ট্রপতির সফরও হচ্ছে।”
জানুয়ারিতে দু’দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পাল্টাপাল্টি সফরে বন্দি-বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। ভিসা প্রক্রিয়া শিথিল করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদ ঢাকা গিয়ে তিস্তা ও স্থল-সীমান্ত চুক্তির জট কিছুটা ছাড়াতে পেরেছেন। সেপ্টেম্বরে শেখ হাসিনার দিল্লি সফর চূড়ান্ত হয়েছে। এর পরে প্রণববাবুর এই সফরে দু’দেশ নতুন কী পাচ্ছে?
বিদেশসচিব মাথাই সাফ জানিয়েছেন, রাজনৈতিক তৎপরতার জন্য প্রণববাবু ঢাকায় যাচ্ছেন না। তিনি রাষ্ট্রপতি। তাঁর এই সফর পুরোটাই সৌহার্দ্যমূলক। মাথাইয়ের বক্তব্যের সূত্র ধরে রাষ্ট্রপতি ভবনের মুখপাত্র রাজামণি বলেন, “একাত্তরে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ জন্ম নেওয়ারও আগে থেকে প্রণববাবুর সঙ্গে এই দেশের নেতাদের ঘনিষ্ঠতা। যত দিন সক্রিয় রাজনীতিতে ছিলেন, বাংলাদেশের বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন তিনি। এখনও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া, বা জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মহম্মদ এরশাদ, বাংলাদেশের সব মহলের সঙ্গে হৃদ্যতা রেখে চলেন রাষ্ট্রপতি। তাঁর এই সফরে সামগ্রিক ভাবে দু’দেশের সম্পর্ক মজবুত হবে।” |
দমন: রবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে জামাতে ইসলামির বিক্ষোভকারীদের
ঠেকানোর চেষ্টা। বাংলাদেশের রাজশাহিতে, শুক্রবার। ছবি: এ এফ পি |
প্রতিশ্রুতি দিয়েও তিস্তার জলের ভাগ ও সীমান্ত নিয়ে চুক্তি ভারত এখনও করে উঠতে পারেনি। এর প্রভাবে সম্পর্ক যে কিছুটা হলেও টাল খেয়েছে, বিলক্ষণ বুজেছে দিল্লি। অথচ, নিরাপত্তার বিষয়ে ঢাকা তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করে গিয়েছে। সে দেশ থেকে ভারতীয় জঙ্গিদের সব ঘাঁটি উৎখাত হয়েছে। ঢাকার নীরব তৎপরতার জেরেই আলফা ও উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন জঙ্গি নেতা একে একে সীমান্ত টপকে বিএসএফের জালে এসে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে থিতিয়ে পড়া সম্পর্কে ফের উষ্ণতার ছোঁয়া আনতে প্রণববাবু ছাড়া আর কাকেই বা দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে? দিল্লি সেই কাজটাই করেছে।
এই মুহূর্তে মৌলবাদীদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে নিজেরাই এক বিরাট পরীক্ষার মুখে পড়ে গিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। পাল্টা কামড় দিয়ে শক্তি প্রদর্শনে নেমেছে মৌলবাদীরা। বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া আজ হিংসার জন্য সরকারকেই দায়ী করে কার্যত জামাতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ভারত অবশ্য বাংলাদেশের এই অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য করছে না। বিদেশমন্ত্রী খুরশিদ আজ বলেন, “আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালত ও তার রায়ের বিষয়ে ভারতের কিছু বলার থাকতে পারে না। কিন্তু যে কোনও হিংসা ও প্রাণহানির ঘটনা দুঃখজনক। আশা করব, বাংলাদেশ সরকার দক্ষতার সঙ্গেই এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সক্ষম হবে।” প্রণববাবুও জানেন, মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে এই পরীক্ষার দিনে তিনি সফর স্থগিত করে দিলে বাংলাদেশ সরকারের মনোবলে ঘা লাগতে পারে। তাই পরিস্থিতির ওপর নজর রেখেও, অন্তত এখনও পর্যন্ত তিনি যাত্রায় অনড়।
মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বিশেষ সম্মান জানাবে বাংলাদেশ সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেবে সাম্মানিক উপাধি। তার বাইরে শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়িতে যাওয়ার কথা প্রণববাবুর। শেষ দিনে নড়াইলের ভদ্রবিলায় কাটাবেন কিছু ক্ষণ। সেখানে যে শ্বশুরবাড়ি রাষ্ট্রপতির। |