পূর্বাভাস মিলেছিল সাতসকালেই। বৃহস্পতিবার বহরমপুর গার্লস কলেজে রেজিনগর বিধানসভা উপনির্বাচনের ভোট গণনা শুরু হতেই ফলাফলের ইঙ্গিত মিলেছিল।
প্রথম রাউন্ড থেকেই কংগ্রেস এগিয়ে যেতে শুরু করে। রাজ্যের প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন দফতরের প্রতিমন্ত্রী হুমায়ুন কবীর একদম প্রথম দিকে গণনাকেন্দ্রে থাকলেও দ্বিতীয় রাউন্ডের শেষে তাঁর কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করে। দিনের শুরুতেই তিনি ভোট-ভবিতব্যের আঁচ পেতে শুরু করেন। বুঝতে পারেন, ভোটদেবতা সম্ভবত তাঁর জন্য তৃতীয় স্থানই বরাদ্দ করে রেখেছেন। ফলে দ্বিতীয় রাউন্ড গণনার শেষে সেই অশনি সংকেত দেখতে পেয়ে মন্ত্রী গার্লস কলেজ ছেড়ে বিমর্ষ মুখে বহরমপুর ট্যুরিস্ট লজের দিকে রওনা দেন।
তখন সবে সকাল সাড়ে আটটা। ট্যুরিস্ট লজের দিকে পা বাড়ানোর সময় তিনি অবশ্য তাঁর অনুগামীদের আশ্বস্ত করে বলেন, “কিছুক্ষণ পর ফের গণনাকেন্দ্রে ফিরছি। তোমরা একদম ঘাবড়াবে না।” কিন্তু গণনা যত এগিয়েছে, গার্লস কলেজে মন্ত্রীর ফিরে যাওয়ার সম্ভবনা ততই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে। অবশেষে ভরদুপুরে মন্ত্রীর রাজনৈতিক জীবনে নেমে আসে জমাট অন্ধকার। ফলে তিনি এ দিন আর গার্লস কলেজমুখো হননি। |
ট্যুরিস্ট লজের ১২১ নম্বর ঘরের মন্ত্রীর মুখে তখন বিষণ্ণতার কালো মেঘ। ঘন ঘন বাজছে মোবাইল দু’টি। কিন্তু ভ্রুক্ষেপহীন তিনি। কখনও আবার কল রিসিভ করে মন্ত্রী তাঁর অনুগামীদের আশ্বস্ত করে বলেন, “এখনই ঘাবড়ে যেও না। এখনও বেশ কিছু রাউন্ড গণনা বাকি আছে। দেখ না শেষ পর্যন্ত কী হয়?”
প্রত্যাশার ওই খড়কুটোটুকু ১২ রাউন্ডের শেষে শেষ। তখন গার্লস কলেজের সামনের উচ্ছ্বল জটলা থেকে ভেসে আসে এক কংগ্রেস সমর্থক যুবকের কণ্ঠস্বর, “কই রে মন্ত্রী কই! ফেনা হয়ে গেল যে! তিনি তো গণনাকেন্দ্র থেকেই পালিয়ে গেলেন!” আর মন্ত্রীর মুখ নিঃসৃত ‘কুড়ুল গাছে’ অধীর চৌধুরীকে বেঁধে ‘টাকা আদায়’-এর প্রসঙ্গ তুলতেই পরাজিত হুমায়ুন বলেন, “আজ ওই প্রসঙ্গ থাক!”
কিন্তু থামছে কোথায়? সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির সদ্য বিধায়ক বিধায়ক রবিউল আলম চৌধুরীর মুখে তখন চওড়া হাসি। হাসি থামিয়ে বলেন, “পার্টি আর জেলা কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বদান্যতায় সামান্য একজন কংগ্রেস সমর্থক থেকে তাঁর ওই রাজনৈতিক উত্থান। অথচ, কৃতজ্ঞতার বদলে তিনি মন্ত্রী হওয়ার লোভে অধীরদা ও কংগ্রেসের সঙ্গে বেইমানি করেছেন। রেজিনগরের মানুষ সেই বেইমানিরই বদলা নিলেন হুমায়ুনকে মন্ত্রীর চেয়ার থেকে সরিয়ে।” |
ফল জানতে ভিড়। —নিজস্ব চিত্র। |
ইভিএম মেশিনে ১০ জন প্রার্থীর নাম ও প্রতীক থাকলেও এ দিন গণনাকেন্দ্রে রবিউল আলম চৌধুরী ছাড়া অন্য কোনও প্রার্থীর টিকিটুকুও (মাত্র আধ ঘণ্টা ছিলেন হুমায়ুন কবীর) দেখা যায়নি। কংগ্রেস ও তৃণমূলের ভোট ভাগাভাগিতে আরএসপি প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম মণ্ডলের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার প্রতীক্ষায় ছিল বাম-শিবির। কিন্তু সকাল ৯টা নাগাদ কয়েক রাউন্ড গণনা হতেই সিরাজুল বুঝে যান তাঁর ভোট-ভবিতব্যের হাল হকিকত। ২০১১ সালের নির্বাচনের মতোই এ বারও তাঁর জয় অধরা জানতে পারার পর নিজের মোবাইল বন্ধ করে দেন জেলা পরিষদের সহকারী সভাধিপতি সিরাজুল। অবশেষে তাঁর দলীয় কর্মীর মোবাইলের সাহায্যে যোগাযোগ করা হলে সিরাজুলের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “টাকার কাছে হেরে গেলাম গো!”
“হেরোদের ওই সব ছেদো কথায় কান দিতে নেই।” মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে ওই মন্তব্য করেন জেলা কংগ্রেস মুখপাত্র অশোক দাস। দলীয় অনুগামীদের নিয়ে দিনভর দলের দফতরে বিজয় উল্লাসে মেতেছিলেন। এক এক রাউন্ড গণনা শেষ হতে না হতেই গার্লস কলেজ থেকে অশোক দাসের মোবাইলে ভোটের পরিসংখ্যান পৌঁছে যায়। সেই খবর অশোক দাস সঙ্গে সঙ্গেই ঘোষণা করেন। তারপরই কংগ্রেসেরজেলা কার্যালয়ের তিনতলা থেকে শুরু করে নীচের রাস্তা পর্যন্ত উপচে পড়া ভিড় থেকে অধীর চৌধুরীর নামে জয়ধ্বনি দেওয়া শুরু হয়। প্রতি রাউন্ড গণনার শেষে কংগ্রেস কার্যালয়ে পৌঁছে যায় মিষ্টির হাঁড়ি। অবশেষে আগের দিনের তৈরি মিষ্টান্নে টান পড়লে শুরু হয় গরম রসগোল্লা বিতরণের পালা। |
|
|
গণনা শেষ। সোল্লাস ও হতাশা। বহরমপুরে ছবি দু’টি তুলেছেন গৌতম প্রামাণিক। |
|
বিধায়কের শংসাপত্র নিয়ে গার্লস কলেজ থেকে দলীয় কার্যালয়ে পৌঁছতেই রেজিনগরের বিধায়ক রবিউল আলম চৌধুরীকে নিয়ে শুরু হয় বিজয় উৎসব। আবির খেলা। সশরীরে ‘রবিনহুড’-কে না পেয়ে অধীর চৌধুরীর ছবিতেই মাখানো হয় আবির। হারের নেপথ্যে হুমায়ুনের ‘সাম্প্রদায়িক’ তত্ত্ব ও সিরাজুলের ‘টাকা’ তত্ত্বের জবাবে দিল্লি থেকে অধীর চৌধুরী বলেন, “রেজিনগরের মানুষকে এ ভাবে অসম্মান করে তাঁরা নিজেরা নিজেদের অপমানিত করছেন। ধন্যাবাদ রেজিনগরের মানুষকে!”
গণনা শেষে হুমায়ুনের এক আত্মীয়ের আক্ষেপ, “অজপাড়াগাঁয়ে ভিলেন শক্তি কাপুর আর খোলামেলা পোশাকে অভ্যস্থ জিনাত আমান এসেই আমাদের মন্ত্রী হুমায়ুনকে ফেনা করে দিল গো!” |