রিষড়ার তৃণমূল কাউন্সিলর বিজয় মিশ্রকে গুলি করার নেপথ্যে জমিজমা-সংক্রান্ত গোলমাল আছে বলেই প্রাথমিক তদন্তে মনে করছে পুলিশ। দাবি মতো টাকা না পেয়ে কুখ্যাতদুষ্কৃতী রমেশের বিরাগভাজন হওয়াতেই ওই ঘটনা, এমন ধারণা তাঁদের।
গুলি চালানোর ঘটনাটি রিষড়া স্টেশনে ট্রেনের মধ্যে হওয়ায়, তদন্ত করছে রেলপুলিশ। পাশাপাশি, জেলা পুলিশের তরফেও তদন্ত হচ্ছে। জেলা পুলিশের এক পদস্থ অফিসার বলেন, “গুলিবিদ্ধ নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কয়েক জনের নাম পাওয়া গিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গেও কথা বলা গিয়েছে। ঘটনাক্রম রমেশের দলবলের দিকেই ইঙ্গিত করছে।”
২২ ফেব্রুয়ারি, ঘটনার দিন ট্রেনে চেপে উত্তরপাড়ায় যান বিজয়বাবু। সেখান থেকে তিনি কোথায় গিয়েছিলেন, তা পুলিশের কাছে স্পষ্ট নয়। বিজয়বাবুর বক্তব্য, উত্তরপাড়ার কাঁঠালবাগান বাজারে এক পরিচিতের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু দেহরক্ষীকে সঙ্গে নিলেন না কেন, কেনই বা ট্রেনে চেপে গেলেন তার উত্তর মেলেনি। বিজয় নিজস্ব গাড়িতেই ঘুরতেন। গোপনীয় কোনও জায়গায় তিনি গিয়েছিলেন বলে পুলিশ মনে করছে। উত্তরপাড়া এবং বালির মাঝে বালিখাল-সংলগ্ন কোনও জায়গায় তিনি গিয়েছিলেন কিনা, পুলিশ তা খতিয়ে দেখছে। রেল পুলিশের এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, “বিজয়বাবুর মোবাইলের কললিস্ট পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। ওই তালিকা হাতে পেলে কিছু সূত্র পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে। তবে বিজয়বাবু এখনও পুরোপুরি মুখ খুলছেন না।”
রিষড়া এবং কোন্নগরের সিংহভাগ জমি কেনাবেচা বা প্রোমোটারি ব্যবসা দীর্ঘদিন ধরেই নিয়ন্ত্রণ করে অন্ধকার জগতের কারবারিরা। সঙ্গে একশ্রেণির পুলিশ অফিসার এবং রাজনীতির কারবারিদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগের অভিযোগও নতুন নয়। এ ক্ষেত্রে টাকার লেনদেনে বনিবনা না হওয়ায় বিপত্তি ঘটে কাউন্সিলরের, এমনটাই মনে করছে পুলিশ।
জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, কিছু দিন আগে রিষড়ায় রেল লাইনের ধারে একটি রবার কেমিক্যাল কারখানার একটি আবাসন (বি’কমপাউন্ড) বিক্রি হয়ে যায়। ওই জায়গাটি কেনাবেচায় সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলর মধ্যস্থতা করেন। উত্তরপাড়া থেকে শুরু করে শ্রীরামপুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ শিল্পাঞ্চলের জমি এবং প্রোমোটারি ব্যবসার অলিখিত নিয়ম যে-ই ব্যবসা করুক না কেন, রমেশের কাছে তোলা পৌঁছে দিতে হবে। সে বছর দেড়েক ধরে জেলে থাকলেও প্রভাব আদৌ কমেনি। জেলে বসেই মোবাইলে এখনও এই শিল্পাঞ্চলে তার দাপট অক্ষুন্ন। এ ক্ষেত্রেও রবার কারখানার জমিটি কেনাবাচার পরে প্রচুর টাকা দাবি করে রমেশ। তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে টালবাহানা চলছিল। সে সবের জেরে দুষ্কৃতীরা বিজয়বাবুর পায়ে গুলি ছোড়ে। তৃণমূলের একটি মহলের বক্তব্য, ওই কাউন্সিলরকে ‘সরিয়ে’ দেওয়া নয়, ‘সমঝে’ দিতেই পায়ে গুলি। ওই অবস্থায় প্ল্যাটফর্মের পাশে রিষড়া থানায় ঢুকে পড়েন বিজয়।
তৃণমূল এবং পুলিশেরই অন্য একটি সূত্র জানাচ্ছে, রিষড়ার বাগখালে গঙ্গা থেকে বালি তোলার ব্যবসা রয়েছে বিজয়ের। তা নিয়েও রমেশের সঙ্গে তাঁর সমস্যা তৈরি হয়েছিল কিনা, তদন্তকারীরা তা খতিয়ে দেখছেন। ঘটনার দিন উত্তরপাড়ার নার্সিংহোমে যখন এক্স-রে চলছে বিজয়ের, তখন বাইরে দাঁড়িয়ে তাঁর ঘনিষ্ঠ দলীয় এক অবাঙালি কাউন্সিলর বলছিলেন, “পুলিশি ব্যর্থতাতেই এই ঘটনা ঘটল। আন্দোলন করে রিষড়াকে স্তব্ধ করে দেব।” ঘটনার পরে পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও তৃণমূল অবশ্য কোনও আন্দোলনের রাস্তায় হাঁটেনি। পক্ষান্তরে, প্রাক্তন সিপিএম পুরপ্রধান দিলীপ সরকার থেকে দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুও দাবি করেছেন, জমি-সংক্রান্ত কারণেই তৃণমূলের ওই কাউন্সিলর গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
বিজয়ের বক্তব্য, “আমার সঙ্গে কারও শত্রুতা নেই। যারা গুলি চালাল, তাদের চিনি না।” তাঁর আরও সংযোজন, “আমাকে মারার জন্য ভাড়াটে গুণ্ডা লাগানো হয়েছিল।” তবে কে তাঁকে মারতে লোক লাগাল, না নিয়ে নিরুত্তর কাউন্সিলর। বছর দশেক আগে ভাগাড়ের জন্য জমি নিতে এক পরিবারকে উচ্ছেদ করার অভিযোগ উঠেছিল বিজয়ের বিরুদ্ধে। সেই সময় তিনি এক ব্যক্তির চোখে বাঁশ ঢুকিয়ে দেন বলে অভিযোগ। পুলিশ তাঁকে গ্রেফতারও করেছিল। কিছু দিন আগেও একটি পরিবারকে উচ্ছেদের অভিযোগ উঠেছিল বিজয়বাবু এবং তাঁর দাদার বিরুদ্ধে। তৃণমূলেরই একটি মহলের মাধ্যমে এ নিয়ে লিখিত অভিযোগও গিয়েছিল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী-সহ রাজ্য তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে। |