পোড়া বাজারের গেটের উল্টো দিকের রাস্তায় বসেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা বিশ্বজিৎ সাহা। আক্ষেপ করছিলেন, ‘‘চেষ্টা করেও মা মেজেনাইন ফ্লোর থেকে নামতে পারল না। আমিও ঢুকতে পারলাম না।’’ বুধবার ভোরে শিয়ালদহের সূর্য সেন মার্কেটে আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয়েছে বিশ্বজিৎবাবুর মা, আশি বছরের জ্যোৎস্না সাহার।
রোজের মতো এ দিনও তিনি ওই মেজেনাইন ফ্লোরের একটি ছোট ঘরে ঘুমোতে গিয়েছিলেন।
সূর্য সেন মার্কেটের উল্টো দিকের কলোনির একটি ছোট ঘরে থাকেন বিশ্বজিৎবাবু। জানালেন, তাঁদের দু’টি দোকান ছিল। দোকানের উপরেই মেজেনাইন ফ্লোরে দু’টি ছোট ঘরও ছিল। বিশ্বজিৎবাবু বলেন, “দোকান দু’টি বিক্রি করে দিলেও দেড় তলার ঘর দু’টি রেখে দিয়েছিলাম। ছোট ঘরে জায়গা না হওয়ায় মা সেখানেই ঘুমোতে যেতেন।”
বৃহস্পতিবার সকালে মার্কেট এলাকা ঘুরে এটা স্পষ্ট যে, মেজেনাইন ফ্লোরে গুদাম, অফিসের পাশাপাশি তৈরি হয়েছিল ‘অলিখিত’ বাসস্থানও। স্থানীয় সূত্রের খবর, এক তলার মেঝে থেকে মেজেনাইন ফ্লোরের ছাদের উচ্চতা ১৭ ফুট। যার প্রায় ৯ ফুট এক তলা দোকানের উচ্চতা, বাকি ৮ ফুট মেজেনাইন ফ্লোর। সেখানেই গড়ে ওঠা ঘুপচি ঘরগুলিতে চার জন মানুষ শোয়ার পরে এক চিলতেও জায়গা থাকে না। প্রথমে মেজেনাইন ফ্লোরে দোকান, গুদাম, তৈরি হলেও পরে সেখানেই মানুষের থাকার জায়গা তৈরি হয় বলে দাবি স্থানীয়দের। |
এলাকাবাসী ও ব্যবসায়ীদের কথায়, এক তলায় কোনও ব্যক্তির দোকান থাকলে ঠিক তার উপরেই মেজেনাইন ফ্লোরে তাঁর ভাগে একটি ঘর থাকে। কেউ দোকান ঘরটি রেখে উপরের ঘরটি বিক্রি করে দেন। যাকে বিক্রি করেছেন, তিনি আবার দেড় তলার ঘরটি কাউকে ভাড়া দেন বা অফিস বা গুদাম বানান। সেই ঘর ভাড়া নিয়ে কোনও ব্যবসায়ী বা বহিরাগত আবার বাসস্থান হিসেবেও ব্যবহার করেন।
বিশ্বজিৎবাবুর মতো এক তলায় দোকান বিক্রি করে অনেকেই মেজেনাইন ফ্লোরে ঘর রেখে দিয়েছিলেন। রাতে সেখানেই ঘুমোতেন তাঁরা। আবার এক তলায় দোকান রয়েছে যাঁদের, অনেক সময় তাঁদের কর্মচারীদের মেজেনাইন ফ্লোরের ছোট ঘরে থাকার বন্দোবস্ত করা হয়। শুতে আসতেন বহিরাগতেরাও। জানা গিয়েছে, সূর্য সেন মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পরিচিতির খাতিরেই এই সুযোগ মিলত।
সূর্য সেন মার্কেটে এপিসি রোডের দিকের এক দোকানি বললেন, “কয়েক বছর আগে একতলার দোকানদারেরা কাঠের পাটাতন দিয়ে উপরের তলাটি বানান। পরে সেটিই কংক্রিটের হয়ে যায়। তার পরেই তৈরি হয় ঘুপচি ঘরগুলি।” সূর্য সেন মার্কেট ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন সোসাইটির সহ-সভাপতি সুশান্ত ঘোষ বলেন, “মাত্র দু’মাস হল কমিটির দায়িত্ব নিয়েছি। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা-সহ অন্যান্য জিনিস ঠিক করতে নোটিস দিয়েছিলাম। তখনও বুঝে উঠতে পারিনি এই বাসস্থানের বিষয়টি।”
স্থানীয় কাউন্সিলর তৃণমূলের অপরাজিতা দাশগুপ্তও বলেন, “বিষয়টি নজরে ছিল। এমন হতে পারে, ভাবিনি। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে এ বার ব্যবস্থা নেব।” স্থানীয় বিধায়ক শিখা মিত্র অবশ্য বিষয়টি জানতেন না বলেই দাবি করেছেন।
বুধবার সূর্য সেন মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়েই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর্জি জানান শহরের কোনও বাজারেই যেন রাতে থাকার ব্যবস্থা না থাকে। মুখ্যমন্ত্রীর এই কথার পরেই বৃহস্পতিবার পুর-কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন, এ বার থেকে কোনও বাজারে রান্না করা চলবে না, রাতে থাকাও যাবে না। সমীক্ষা করা হবে শহরের বিভিন্ন বাজারে। |