|
|
|
|
কৌশলে বার্তা বিরোধীদেরও |
নির্ভয়া তহবিল, দিল্লি-কাণ্ডের ছায়া বাজেটেও |
অনমিত্র সেনগুপ্ত • নয়াদিল্লি |
দিল্লির বাসে গণধর্ষণ ও হত্যার পরে ক্ষোভে যে রকম ফেটে পড়েছিলেন মানুষ, শুরু হয়েছিল তীব্র আন্দোলন এই মুহূর্তে তেমনটা হয়তো হচ্ছে না। কিন্তু ক্ষোভের ক্ষতটা এখনও গভীর। মিলিয়ে যায়নি গণঅসন্তোষও। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই নারী ক্ষমতায়নে নতুন পদক্ষেপ করলেন সনিয়া-মনমোহন। বাজেটে দেশের প্রথম মহিলা ব্যাঙ্ক, নারী সুরক্ষায় নির্ভয়া নামে এক হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন ছাড়াও নারী ও শিশুকল্যাণ উন্নয়নে বড় মাপের অর্থ বরাদ্দ করলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম।
জয়পুরে দলের চিন্তন বৈঠকেই ওই গণধর্ষণ কাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী। উদ্দেশ্য ছিল, জনমানসে সরকারের বিরুদ্ধে যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে, তাতে প্রলেপ দেওয়া। ওই বৈঠকে মহিলাদের সামগ্রিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা শুধু নয়, তাঁদের আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী করে তোলার উপরেও জোর দিয়েছিলেন সনিয়া। তারই প্রতিচ্ছবি এ বার সরকারের পদক্ষেপেও। লোকসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে এ বার প্রশাসনিক ভাবেও নারীদের সামগ্রিক উন্নতিতে জোর দিল ইউপিএ নেতৃত্ব।
এর স্পষ্ট লক্ষ্য দু’টি। এক, আসন্ন লোকসভা ভোটের আগে মহিলাদের মনে এই আস্থা জাগানো যে, সনিয়া-মনমোহনদের সরকারই তাঁদের কল্যাণে আন্তরিক ভাবে কাজ করছে। দ্বিতীয় লক্ষ্য, বিরোধী আক্রমণের পরিসরকে সংকীর্ণ করে দেওয়া। গণধর্ষণ-কাণ্ডের জেরে বিক্ষোভের যে বিস্ফোরণ ঘটেছিল দেশ জুড়ে, তাকে কেন্দ্রীয় ও দিল্লির কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে চালিত করতে তৎপর হয়ে উঠেছিল প্রধান বিরোধী দল বিজেপি ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলি। একই লক্ষ্যে ময়দানে ঝাঁপায় অরবিন্দ কেজরিওয়াল বা রামদেবের মতো আপাত অরাজনৈতিক শক্তিও। কিন্তু যুব-বিক্ষোভকে সঙ্গত আখ্যা দিয়ে এবং তাকে সমর্থন জানিয়ে রাহুল গাঁধী সে সময়ই বিরোধীদের পরিসরটাকে খানিকটা সংকীর্ণ করে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। পরে নারী নিরাপত্তা নিয়ে জয়পুরে সনিয়ার উদ্বেগ প্রকাশে কংগ্রেস আরও এক ধাপ এগিয়েছিল সেই লক্ষ্যে। এ বার সরকারের পালা।
দেশে মহিলাদের জন্য আলাদা স্কুল বা কলেজ চালু হয়েছে দীর্ঘদিন আগেই। আছে মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ও। ট্রেন, বাস, মেট্রোর মতো গণপরিবহণ ব্যবস্থায় রয়েছে মহিলাদের জন্য বিশেষ আসন সংরক্ষণ ব্যবস্থাও। কিন্তু আজ মহিলাদের জন্য আলাদা একটি ব্যাঙ্কের ঘোষণা করে সবাইকে চমকে দেন চিদম্বরম। দু’দিন আগে রেল বাজেটে মহিলা রেল-পুলিশের নিয়োগ ও ট্রেনে তাদের মোতায়েন করার কথা জানিয়ে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে চেয়েছে ইউপিএ সরকার। আজ জোর দেওয়া হল তাঁদের আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী করে তোলার উপর।
বাজেট বক্তৃতায় চিদম্বরম আজ বোঝাতে চেয়েছেন, সমাজে নারীরা কোনও অর্থেই পিছিয়ে নেই। তবু বিভিন্ন ক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তাঁরা। এই পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেই অর্থমন্ত্রী আজ শুধু মহিলাদের জন্য একটি ব্যাঙ্ক গড়ার প্রস্তাব দেন। যেখানে কাজ করবেন মহিলারা তাঁদেরই আর্থিক সমৃদ্ধি ও ক্ষমতায়নের পথকে প্রশস্ত করবে এই ব্যাঙ্ক। অক্টোবর মাসের মধ্যে ওই ব্যাঙ্কের কাজকর্ম শুরু হয়ে যাবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
দীপা দাশমুন্সির মতো কংগ্রেসের মহিলা সাংসদরা একে সমর্থন জানালেও এর সমালোচনায় মুখর হয়েছেন অনেকেই। সে দলে পিছিয়ে নেই মহিলারাও। সমাজবাদী সাংসদ তথা উত্তরপ্রদেশ মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী ডিম্পল যাদব মনে করেন মাত্র হাজার কোটি টাকায় কোনও কাজের কাজই হবে না। তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায় বলেন, “মহিলারা তো এখন আর পর্দানসীন নন। তাই শুধু মহিলাদের জন্য ব্যাঙ্ক সংরক্ষণ না করে বরং তাঁদের কাজের সুযোগ করে দিক সরকার। মহিলারা ব্যাঙ্ক থেকে যে ঋণ নেবেন, তা শোধ দেওয়ার জন্যও যে আর্থিক সামর্থ্য দরকার, তার ব্যবস্থা করা অনেক বেশি জরুরি।” আর এক ধাপ এগিয়ে মিডিয়াব্যক্তিত্ব তথা সাংবাদিক প্রীতীশ নন্দীর কটাক্ষ, “দুর্দান্ত পদক্ষেপ! আমরা মহিলাদের উপর শারীরিক অত্যাচার, ধর্ষণ আটকাতে পারছি না, অথচ তাদের জন্য আলাদা ব্যাঙ্ক খুলছি। ভাবটা এমন যে, মহিলারা সাধারণ ব্যাঙ্কে যেতে পারেন না।” কংগ্রেস নেতৃত্ব অবশ্য এই সমালোচনাকে আমল দিতে বা পিছিয়ে আসতে নারাজ। তাঁরা স্পষ্ট জানিয়েছেন, মহিলাদের উন্নয়নে কংগ্রেস দায়বদ্ধ।
নারীর সুরক্ষা থেকে স্বাবলম্বন এবং সামগ্রিক ভাবে ক্ষমতায়নকে সরকার কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে, আজ তার প্রকাশ দেখা গিয়েছে চিদম্বরমের সাংবাদিক বৈঠকেও। সেখানে এ দিন সবার আগে মহিলা সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হয়। বাজেট বক্তৃতাতেও এই একই বার্তা দিতে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেন চিদম্বরম। তাঁর কথায়, সাম্প্রতিক দিল্লি-কাণ্ড দেশের উদার ভাবমূর্তি ক্ষতি করলেও মহিলাদের সম্মান ও সুরক্ষায় সরকার দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে। কংগ্রেসেরও বক্তব্য, শুধু সুরক্ষা নয়, মহিলাদের সত্যিকারের ক্ষমতায়নে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তা পূরণ করতেই এক হাজার কোটি টাকার ‘নির্ভয়া’ তহবিল গড়ার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র। রাজনীতির কারবারীরা মনে করছেন, গণধর্ষণ কাণ্ডের নির্যাতিতা তরুণীর কথা মাথায় রেখেই ওই তহবিল গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। বিক্ষুব্ধ জনতাকেও বার্তা দিতে চেয়েছে কংগ্রেস নেতৃত্ব। তবে ওই তহবিলের অর্থ কী ভাবে খরচ করা হবে তা স্পষ্ট করেননি চিদম্বরম। কী ভাবে ওই অর্থ মহিলাদের উন্নতিতে খরচ করা সম্ভব তা দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রককে। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়ারানি রুখতেও তৎপর সরকার। সমীক্ষা বলছে, অবিবাহিত ও বিধবা মহিলারা কাজের জায়গায় সব থেকে বেশি যৌন হেনস্থার শিকার হন। দেখা যাচ্ছে, যত বেশি মহিলা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন তাঁদের হেনস্থার অভিযোগও তত বাড়ছে। বহু মহিলাই অভিযোগ জানাতে এগিয়েও আসেন না। ভবিষ্যতে নারীদের সুরক্ষা কী ভাবে সুনিশ্চিত করা সম্ভব সেই দিশানির্দেশ ঠিক করতে নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রককে ২০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত সাহায্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বাজেটে। |
|
|
|
|
|