দিনের শুরুটা দেখলে বাকি দিনটা কেমন যাবে বোঝা যায়। এই কথাটাই যেন সত্যি হল নলহাটি বিধানসভার উপনির্বাচনে। গণনার শুরুতেই পাঁচটি পোস্টাল ভোটে ৪-১ ভোটে এগিয়ে গিয়েছিল ফরওয়ার্ড ব্লক। তখনই ফিসফিসানি শুরু হয়েছিল, বামেদের লক্ষণ ভাল। দিন শেষে হাসলেন সেই ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থীই দীপক চট্টোপাধ্যায়।
তবে গণনার ফলের গতি প্রকৃতি দিনভর ততটা মসৃন ছিল না। রাউন্ডে রাউন্ডে ফল বদলেছে, কর্মীদের উচ্ছ্বাসেও তেমনি জোয়ার-ভাটা খেলেছে। এ যেন ম্যারাথন দৌড়। প্রথম রাউন্ডের ফল ঘোষণার পর দেখা গেল বাকিদের থেকে বেশ কয়েক কদম এগিয়ে রয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী আব্দুর রহমান। ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রার্থীর তুলনায় তিনি ১,১০৮ ভোটে এগিয়ে। রাজনীতির কারবারিরা বলে ওঠেন, “এমনটাই তো হওয়ার কথা। প্রথম কয়েকটা রাউন্ডে কংগ্রেস তো ভোট টানবেই।” তখন কংগ্রেসের রুদ্রনগর পঞ্চায়েত এলাকার গণনা চলছিল। দ্বিতীয় রাউন্ডের ফল বিস্ময়কর। দেখা গেল কংগ্রেস ও তৃণমূলের থেকে অনেক বেশি ভোট পড়েছে ফরওয়ার্ড ব্লকের ঝুলিতে। ব্যবধান কমলেও এগিয়ে থাকল অবশ্য কংগ্রেসই। কংগ্রেসের ঘাঁটি এই কুশমোড় ১ পঞ্চায়েত এলাকায় এত ভোট পাবেন আশা করেননি খোদ ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থীও। দীপকবাবুর কথায়, “আমিও ভাবতে পারিনি, ওখানে এতটা ভোট পাব।” তবে তৃতীয় ও চতুর্থ রাউন্ডে কংগ্রেস ব্যবধান বাড়িয়ে নেয়। ফরওয়ার্ড ব্লক দ্বিতীয় স্থান ধরে রাখলেও তৃণমূল গোড়া থেকে সেই তৃতীয় স্থানেই আটকে ছিল। |
গণনা কেন্দ্র রামপুরহাট কলেজের পাশেই রামপুরহাট হাইস্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। তাই এ বার গণনা কেন্দ্রের ভিতর থেকে বাইরে মাইকে প্রতি রাউন্ডে ফল ঘোষণার ব্যবস্থা ছিল না। বিভিন্ন দলের কর্মীরা অবশ্য যথারীতি গণনা কেন্দ্রের বাইরে ছিলেন। কিন্তু দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই কংগ্রেস কর্মীদের জটলার আয়তন বাড়তে থাকে। দমবন্ধ পরিবেশটা কেটে গিয়ে কংগ্রেস কর্মীদের হাসিঠাট্টা করতে দেখা যায়। অনেকেই তৃণমূলের কর্মীদের টিটকিরি দেন। তবে তাঁদের উচ্ছ্বাস বেশি ক্ষণ স্থায়ী হয়নি।
পঞ্চম রাউন্ডে বানিওর পঞ্চায়েত এলাকার গণনায় হিসেব উল্টে গেল। কংগ্রেসকে পিছনে ঠেলে ১,৬২৮টি ভোটের ব্যবধান নিয়ে এগিয়ে গেল ফরওয়ার্ড ব্লক। তৃণমূল তখনও ৩,৫৯০টি ভোটে পিছিয়ে। এখান থেকেই গতি বাড়িয়ে নেয় ফরওয়ার্ড ব্লক। তত ক্ষণে দলীয় কার্যালয় থেকে বামফ্রন্টের কর্মীরা গুটি গুটি গণনা কেন্দ্রের বাইরে জড়ো হতে থাকেন। কারণ সপ্তম রাউন্ড থেকে বামেদের এলাকার ভোট গণনা হওয়ার কথা। উৎসাহে ফুটছিলেন বামপন্থী কর্মীরা। ততটাই আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল তৃণমূল ও কংগ্রেস কর্মীদের মধ্যে। আশঙ্কা, এ বার ব্যবধান কতটা বাড়বে!
|
কপাল খোলে তৃণমূলের। অষ্টম রাউন্ডের পর প্রথমবারের জন্য দ্বিতীয় নম্বরে উঠে আসে তৃণমূল। তৃতীয় স্থানে নামে কংগ্রেস। কিন্তু ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থীকে অনেকখানি এগিয়ে যেতে দেখে তত ক্ষণে অনেক তৃণমূল কর্মীই হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। হার এক প্রকার নিশ্চিত বুঝে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা এলাকা থেকে সরতে শুরু করেন। নলহাটি এলাকার এক তৃণমূল নেত্রী হামিমা বিবি ক্ষোভ না লুকিয়ে কর্মীদের বলেন, “এ বার প্রার্থী বাছাটাই ভুল হয়েছে। অন্য কাউকে প্রার্থী করলে বরং ভাল ফল হত।”
সিউড়ির তৃণমূল নেতা প্রাক্তন কংগ্রেস পুরপ্রধান জহর মিশ্র অবশ্য কর্মীদের বার বার সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, “পরের রাউন্ডেই আমরা এগিয়ে যাব।” ভরসা ছিল নলহাটি পুরএলাকার ভোট। নবম ও দশম রাউন্ডে নলহাটি পুরএলাকার ভোট গণনা শুরু হয়। এই পুরসভার প্রাক্তন উপপুরপ্রধান তৃণমূল প্রার্থী বিপ্লব ওঝা। যদিও গত বছর নলহাটি পুরভোটে দু’টি ওয়ার্ডেই বিপ্লববাবু হারেন। তবুও তাঁর দলের কর্মীদের মনে আশা ছিল, শহরে ঢুকলেই ফরওয়ার্ড ব্লক টের পাবে। কিন্তু গণনা এগোতেই ফল দেখে মুখ ভার হয়েছে তৃণমূল কর্মীদের। ফরওয়ার্ড ব্লকের সঙ্গে ব্যবধান কিছুটা কমলেও তৃণমূল সেই দ্বিতীয় স্থানেই আটকে থাকে। দলের জেলা সহ-সভাপতি মলয় মুখোপাধ্যায় গণনাকেন্দ্র থেকে নীচে নেমে পায়চারি করতে লাগলেন। মলয়বাবু বললেন, “শহর থেকে যে ভোট পাওয়ার কথা ছিল, সেই ভোট আমরা পাইনি।”
এগারো রাউন্ডের শেষে তৃণমূলকে টপকে ফের দ্বিতীয় স্থানে উঠে এল কংগ্রেস। ১৪ রাউন্ডের ফিনিসিং পয়েন্টেও এগিয়ে থাকলেন সেই ফরওয়ার্ড ব্লকের দীপকবাবু। তত ক্ষণে গণনা কেন্দ্রের বাইরে তৃণমূলের চেনামুখেরা বেপাত্তা। মাঠ আঁকড়ে পড়েছিলেন জহরবাবু। এক তৃণমূল কর্মীর খেদোন্তি, “কংগ্রেস তো তবু কিছু ক্ষণ প্রথম স্থানে ছিল, আমরা এক বারও ওই জায়গাটায় পৌঁছালাম না।” গণনা কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এসেছেন দীপকবাবু। কে যেন তাঁর মাথায় একমুঠো লাল আবির মাখিয়ে ছিলেন। দ্বিতীয় বার বিধানসভায় যাওয়ার সুযোগ পেয়ে বললেন, “তৃণমূল সরকারের কুড়ি মাসের অভিজ্ঞতার জেরে মানুষ এই রায় দিয়েছেন।”
|