ক্লাস চলছে। চেয়ারে উৎসুক পড়ুয়াদের ভিড়। সামনের মঞ্চের এক ধারে পর্দায় ভেসে উঠছে একের পর এক স্লাইড, কাচের বাক্সে ঝুলছে পূর্ণ দেহের কঙ্কাল। ক্লাস নিচ্ছেন অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরা। বোঝাচ্ছেন ‘অ্যানাটমি’। বোঝাচ্ছেন নানা জটিল রোগের উপসর্গ, রক্ত ও নানা নমুনা পরীক্ষার খুঁটিনাটি, ওষুধের গুণাগুণ। খাতা-কলম খুলে তার বিস্তারিত নোট নিচ্ছেন গ্রামের হাতুড়ে চিকিৎসকেরা।
সমালোচনা করে দূরে ঠেলে না দিয়ে কী ভাবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হাতুড়ে ডাক্তারদের যথার্থ ভাবে কাজে লাগানো যায় সে নিয়ে অধুনা কিছু উদ্যোগ শুরু হয়েছে। বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে তেমনই একটি প্রকল্পে সামিল হয়েছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। স্বাস্থ্য দফতরের টাকায় বীরভূমের গ্রামে হাতুড়ে ডাক্তারদের বিজ্ঞানভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। আর প্রশিক্ষণ পেয়ে আদৌ কতটা লাভ হচ্ছে তা নির্ণয় করছে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (এমআইটি)। |
সম্প্রতি এই প্রকল্প সরেজমিনে দেখতে বীরভূমের গ্রামে ঘুরলেন এমআইটি-র শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। হাতুড়ে ডাক্তারদের পাশে বসে ক্লাস করলেন। পড়ুয়ারা কী শিখছে, কতটা শিখছে তা যাচাই করার জন্য প্রশ্নও করলেন। শুধু রাজ্য নয়, গোটা দেশেই এমন প্রকল্প এই প্রথম বলে উদ্যোক্তাদের দাবি। স্বাস্থ্যকর্তারা স্বীকার করেছেন, প্রকল্প সফল হলে গ্রাম বাংলায় আক্ষরিক অর্থেই বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর সংখ্যা অনেকটাই কমানো যাবে।
স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “এটা আমাদের পাইলট প্রজেক্ট। সফল হলে অন্যত্রও তা ছড়িয়ে দেওয়া হবে। হাতুড়ে ডাক্তারদের সমস্যা হল, কোথায় থামতে হয় তা জানেন না। প্রশিক্ষণে সেই বার্তাটাও স্পষ্ট পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা হবে।”
হাতুড়ে ডাক্তারদের নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। যেমন, তাঁরা নামের আগে অবৈধ ভাবে ‘ডাক্তার’ পরিচয় লেখেন, যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করেন, রোগ গুরুতর বুঝেও রোগীকে হাসপাতালে না পাঠিয়ে নিজের হাতে রেখে কার্যত মেরে ফেলেন ইত্যাদি। ফলে তাঁদের প্রশিক্ষণ দিলে হিতে বিপরীত হওয়ার ভয়ই বেশি। একদিকে এমন অভিযোগের বন্যা, আর অন্য দিকে পাশ করা ডাক্তারদের গ্রামে যেতে প্রবল অনীহার বাস্তব চিত্র। যার জেরে অসুখে পড়লে বহু ক্ষেত্রেই বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়াটাই ভবিতব্য হয়ে ওঠে অনেকের কাছে। অভিজিৎ বিনায়কের কথায়, “দুটো পথ আছে। একটা পথ হল এই গ্রামীণ স্বাস্থ্য সহায়করা খুব অন্যায় করছেন, এমন সমালোচনা করে চুপ করে বসে থাকা। এটা খুব সহজ পথ। আর অন্যটা হল, স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর হাল রাতারাতি বদলাবে না তা মেনে নিয়ে কী ভাবে এই মানুষগুলোকে কাজে লাগিয়ে পরিস্থিতির খানিকটা উন্নতি করা যায়, তার চেষ্টা করা। এ ক্ষেত্রে সেটাই হচ্ছে।”
এমনিতেই হাতুড়ে ডাক্তাররা বহু ক্ষেত্রে জটিল রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনেন। এই প্রশিক্ষণকে শিখণ্ডী খাড়া করে এর পরে এঁরা আরও দুঃসাহসী হয়ে উঠবেন না তো? অভিজিৎ বিনায়কের কথায়, “সেই আশঙ্কাটা কম। কারণ ভুল চিকিৎসায় লোক মারলে যে ওঁরাও নিস্তার পাবেন না, সেটা ওঁদের সামনে স্পষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। প্রাথমিক স্তরে চিকিৎসা করে এক জন রোগীকে কী ভাবে বাঁচানো যায়, সেটাই শেখানো হচ্ছে এই প্রশিক্ষণে। পাশাপাশি সতর্ক করা হচ্ছে যাতে তাঁরা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে রোগীর ক্ষতি না করেন।”
প্রকল্প অধিকর্তা পার্থ মুখোপাধ্যায় জানান, প্রথম দফায় তাঁরা ৩০০ জন গ্রামীণ স্বাস্থ্য সহায়ককে বেছে নেন। তাঁদের মধ্যে ১৫০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়েছে। বাকি ১৫০ জনকে দেওয়া হচ্ছে না। ৯ মাস এই প্রশিক্ষণ চলার পরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা অন্যদের থেকে কতটা এগিয়ে, আদৌ এগিয়ে কি না, দেখা হবে। এই পর্যালোচনার কাজটাই করছে এমআইটি।
প্রশিক্ষণ নিতে আসা বীরভূমের পারুইয়ে মহম্মদ ফতেমুস, ঘুরিষায় শহিদুল ইসলাম কিংবা কয়র্যার সঞ্জিত গঙ্গোপাধ্যায়রা অবশ্য নতুন কিছু শেখার পাশাপাশি নিজেদের দাবিদাওয়াগুলোও তুলতে ভোলেননি। রোগী পিছু ১০ টাকা ‘ভিজিট’ নেওয়া সঞ্জিত হুঁশিয়ারি দেন, “সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা এক দিন ধর্মঘট করলে মানুষের যে ভোগান্তি হয়, আমরা কাজ না করলে পরিস্থিতি তার কয়েক গুণ বেশি খারাপ হবে। এটা সরকারি কর্তাদের মনে রাখা দরকার।” ছোটখাটো অস্ত্রোপচার করেন ফতেমুস, অ্যান্টিবায়োটিকও দেন। এই প্রশিক্ষণের পর সেটা কি বদলাবে? জিভ কেটে ফতেমুস বলেন, “ভুলগুলো শুধরে নিতে হবে। এখানে বড় ডাক্তারবাবুরা শেখাচ্ছেন কোনটাকে ‘ম্যালপ্র্যাকটিস’ বলে। তবে আমাদের তো কোনও সম্মানই নেই। আমাদের ছাড়া যখন চলবে না, তখন সরকারের উচিত কিছুটা স্বীকৃতির ব্যবস্থা করা।”
উদ্যোক্তা সংস্থা লিভার ফাউন্ডেশনের তরফে চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরী কোনও রাখঢাক না করেই বলে দিলেন, “কোনও ধোঁয়াশা রাখবেন না। আপনারা কোনও দিন নামের আগে ডাক্তার লিখতে পারবেন না। কখনও কোনও ডিগ্রি পাবেন না। কোনও দিন সরকারি চাকরি পাবেন না। কোনও দিন জটিল রোগের টিকিৎসা বা অস্ত্রোপচার করতে পারবেন না। যা পারবেন তা হল যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রাথমিক চিকিৎসা।”
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজ্যের ৩৮ হাজার গ্রামে হাতুড়ে ডাক্তারের সংখ্যা প্রায় দু’লক্ষ। আর রাজ্যে নথিভুক্ত চিকিৎসকের সংখ্যা ৪০ হাজার। পরিস্থিতিটা ঠিক কেমন, এ থেকেই তা স্পষ্ট হয়। হাওড়ায় হাতুড়ে চিকিৎসকদের নিয়ে একটি প্রকল্পের সংগঠকদের অন্যতম, শল্যচিকিৎসক কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায় অবশ্য মনে করেন, ‘হাতুড়ে’ শব্দটার মধ্যে এক ধরনের অবমাননা রয়েছে। বলা উচিত পল্লিচিকিৎসক। কৃষ্ণেন্দুবাবুর কথায়, “আদর্শ পরিস্থিতিতে এই ধরনের চিকিৎসকের অস্তিত্ব থাকা উচিত নয়। কিন্তু সেই আদর্শ পরিবেশ কবে আসবে কেউ জানে না। তাই সরকারি তরফে এঁদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে স্বীকৃতি দেওয়া দরকার।” |