টিম ইন্ডিয়ার কোচ থাকাকালীন চাকরির সঙ্গে নাকি একটা ব্যবসা ফাঁদার কথাও ভেবেছিলেন তিনি। ব্যবসাটা হল, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ভারতে যখন যেখানে তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ হচ্ছে, তার প্রতিটা থেকে এক ডলার করে কমিশন নেবেন। “চার দিকে যে ভাবে কুশপুতুল পুড়ছিল, তাতে বেশ বড়লোক হয়েই আমি অস্ট্রেলিয়া ফিরতে পারতাম,” ছ’বছর পরে তীব্র আক্ষেপ গ্রেগরি স্টিভন চ্যাপেলের।
বুধবার মধ্য কলকাতার পাঁচতারা হোটেলে দ্বিতীয় পটৌডি স্মারক বক্তৃতা যখন এ ভাবেই শাণিত রসিকতায় শুরু করলেন গুরু গ্রেগ, ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেল, সৌরভের পাড়ায় আজ কি আগাগোড়া এমনই আক্রমণাত্মক থাকবেন? ওয়েস্ট ইন্ডিজের চার ফাস্ট বোলারের বিরুদ্ধে পঁচাত্তরের সিরিজে যে সব উদ্ভাবনী শট খেলে ১১৭ গড় রেখেছিলেন, সেগুলো কি ঝোলা থেকে ফের বার করে আনবেন? নাকি অভিজাত টেস্ট ক্রিকেটে বরাবরের তাঁর যা ট্রেডমার্ক শট, সেই অভিজাত অন ড্রাইভের ওপর থাকবেন? |
নাহ্, স্মারক বক্তৃতায় গ্রেগ দ্বিতীয় রাস্তাতেই হাঁটলেন। চিরবিতর্কিত গ্রেগকে কোথাও যেন ছাপিয়ে গেলেন সেই গ্রেগ, যিনি চাকুরিগত ভাবে যুক্ত ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে। ভারতীয় বোর্ডকে বিব্রত করতে পারে, এমন কোনও বিতর্কে যে সংস্থার তীব্র অনীহা। যারা গত বছর প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনী ‘ফিয়ার্স ফোকাস’ থেকে তিরিশ পাতা এডিট করে বাদ দিয়েছে। পাতাগুলোতে কী ছিল? ছিল ভারতীয় কোচ হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতা এবং সৌরভ প্রসঙ্গ। হয়তো সে জন্যই সহজ বক্স অফিসের রাস্তা মাড়ানইনি গ্রেগ। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নামটাও উচ্চারণ করেননি। অথচ আধ ঘণ্টার কাছাকাছি তাঁর শল্যচিকিৎসকধর্মী বক্তব্যে দর্শকরা যে প্রবাদপ্রতিম অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারকে পেলেন, তাঁর বিশ্লেষণী মননে মুগ্ধ ছিলেন স্বয়ং পটৌডি। সেই গ্রেগই যেন স্মারক বক্তৃতায় ডানা মেললেন। যিনি বিশ্লেষক। যিনি তার্কিক। যিনি দিশারী। পটৌডি-গ্রেগে প্রথম সাক্ষাৎ ১৯৬৮-তে ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফরে। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট নিয়ে দু’জনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ কথাবার্তা এর আটত্রিশ বছর পরে, নয়াদিল্লিতে। ভারতীয় ক্রিকেটে অনেক পরিবর্তন এনেছিলেন পটৌডি। আর গ্রেগ তো বরাবরই স্থিতাবস্থা থেকে পরিবর্তনের প্রতিনিধি। যে পরিবর্তনের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন ছিল টাইগারের।
স্বাগত ভাষণেও আনন্দবাজার সংস্থার প্রধান সম্পাদক অভীক সরকার বলেন, “সেই মহাভারতের যুগের কৃষ্ণ থেকে মনমোহন সিংহ পর্যন্ত যাঁরাই যখন পরিবর্তন আনতে চেয়েছেন, তাঁদের তীব্র লড়াই করতে হয়েছে। যেমন করতে হয়েছে গ্রেগকে। মাইকেল ক্লার্করা জানলে মোটেও খুশি হবেন না যে চেন্নাইয়ে তাঁদের টিমকে যিনি সংহার করলেন, ঝাড়খণ্ডের সেই মাণিক্যকে নেতৃত্বের দাবিদার হিসেবে প্রথম চিহ্নিত করেছিলেন এক অস্ট্রেলীয়ই। অবশ্যই তাঁর নাম গ্রেগ চ্যাপেল।” ঠিক তখনকার সমবেত হাততালিতে বোঝা যায়নি এটা যে সৌরভের শহর! ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ ও বেঙ্গল ক্লাব আয়োজিত স্মারক বক্তৃতায় মেলবোর্ন থেকে উড়ে আসা অস্ট্রেলীয় বারবার টেনে আনলেন ধোনির প্রসঙ্গ। ভারতীয় ক্রিকেট সভ্যতাকে ব্যাখ্যা করার জন্য। বললেন, “ভারত হল বিশ্বক্রিকেটের ব্রাজিল। ব্রাজিল ছাড়া যেমন বিশ্বকাপ ফুটবল হয় না, ভারত ছাড়া তেমনই বিশ্বক্রিকেট হয় না। তেন্ডুলকরকে আমি মনে করি ‘পেলে অফ ক্রিকেট’। আর মনে করি ভারতের বিশ্বক্রিকেটের সুপার পাওয়ার হওয়া উচিত। ভারতের যা জনসংখ্যা, পাঁচটা সেরা টিম ওদেরই তৈরি করা উচিত।” টাইগার আর তাঁর দিল্লির আলোচনায় দু’জনেই একমত হয়েছিলেন, ঘরোয়া ক্রিকেটে রুদ্ধশ্বাস প্রতিদ্বন্দ্বিতা আনতে টিমের সংখ্যা অনেক কমিয়ে আনা উচিত। উচিত দলীপ ট্রফি তুলে দেওয়া। ভারতীয় দলের কোচ হিসেবে গুরু গ্রেগের প্রকল্পের নাম ছিল ‘ভিশন ফর এক্সেলেন্স’। সেই এক্সেলেন্স ধাওয়া করার প্রসঙ্গ ফিরিয়ে আনলেন চ্যাপেল। বললেন, “উৎকর্ষ কখনও দুর্ঘটনা হতে পারে না। উৎকর্ষ কখনও চান্স ফ্যাক্টরের ওপরও তৈরি হয় না। ভারতীয় ক্রিকেটকে বুঝতে হবে, অ্যাড হক ভিত্তিতে সাফল্য আসতে পারে না। উৎকর্ষ তৈরি হয় সচেতন সিদ্ধান্তের ওপর।” তাঁর বক্তৃতার শেষে বলতে উঠে শর্মিলা ঠাকুর বললেন, “গ্রেগের বলা এই জায়গাটা আমার দারুণ লাগল।”
ইউটিউবে বুধবারের স্মারক বক্তৃতার অংশবিশেষ দেখা যাবে কি না, জানার জন্য ক’দিন ধরেই ছটফট করছিলেন বেদি-প্রসন্নরা। তাঁরা দেখলে বুঝবেন, চ্যাপেল হয়তো বক্স অফিস বিতর্ক পরিহার করেও ক্রিকেট চিন্তার মেরুকরণ করে দিয়ে গেলেন। ব্যতিক্রমী পরামর্শ তাঁর। স্কিল অন্বেষণের জন্য ডাক দিলেন প্রকৃতিগত উৎসে। বললেন, “ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ট্যালেন্ট লুকিয়ে থাকে না। ট্যালেন্ট বেড়ে ওঠে স্বাভাবিক ভাবে। ব্রাজিল যেমন ফিটনেস বাড়িয়ে, পেশিশক্তি বাড়িয়েও দেখেছিল ওদের টিম ভাল খেলতে পারছে না। কারণ সাবেকি স্কিলের সেই ঘরানা ও ভাবে অঙ্ক মেপে তৈরি করা যায়নি।” চ্যাপেল প্রথম ভারতীয় কোচ, যাঁর আমলে দেশের নানান স্যাটেলাইট শহর এবং গ্রামগঞ্জ থেকেও অবিরাম লোকে টিম ইন্ডিয়ার হয়ে খেলেছে। বহু সমালোচিত হয়েও মূল থিম থেকে তিনি সরে যাননি যে, দাও ফিরে সেই পুরনো সব খেলার মাঠ, লও এই ক্রিকেট অ্যাকাডেমি!
ভারত অধিনায়কের কথা এই প্রসঙ্গেই বারবার উঠে এল। বেঙ্গালুরু ক্যাম্পে এক বার অজিত আগরকরকে দিয়ে ধোনিকে বারবার শর্ট পিচ করাচ্ছিলেন চ্যাপেল। আর বলগুলো ক্রমাগত অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল স্টেডিয়ামের ছাদের ওপর দিয়ে। একটা প্রচণ্ড গতিতে গিয়ে লাগে ওপরের কংক্রিটে। আজকের চ্যাপেলও মুগ্ধ বিস্ময়ে আচ্ছন্ন, “ক্রিকেট বল এত জোরে মারতে আর এত বিভিন্ন জায়গায় মারতে আমি এর আগে কখনও দেখিনি।” গুরু গ্রেগের মন্ত্র হল, বিশ্বক্রিকেটের ব্রাজিল হতে চাইলে ভারতকে অ্যাকাডেমি নির্ভরতা শিকেয় তুলে ফিরে যেতে হবে স্বাভাবিক প্রতিভার উৎসমুখে। সেই প্রতিভা যতই অবৈজ্ঞানিক ভাবে তৈরি হয়ে আসুক। প্লেয়ারকে তৈরি হতে দিতে হবে বিভিন্ন ধরনের উইকেটে। কোন সারফেসে খেলব তার ওপর পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ রাখা যাবে না।
কোথাও কি সিনিয়র ভারতীয় ক্রিকেটের মনোভাবকে তীব্র ব্যঙ্গ করলেন চ্যাপেল? কেন না, এর পরেই বললেন, “টেস্ট ক্রিকেট জীবনকে অনেক কিছু শেখায়। সবচেয়ে বড় শিক্ষা দেয় জীবনে ব্যর্থতার সঙ্গে সমঝোতা করতে। ব্র্যাডম্যানের মতো যুগন্ধরও জীবনের ৮০ ইনিংসে মাত্র ২৯ সেঞ্চুরি করেছেন। ওঁর মতো প্রতিভাও যেখানে ৫১ বার ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানে আমাদের ব্যর্থতা মেনে নিতে সমস্যা কোথায়?” এটাও কি কোথাও সূক্ষ্ম খোঁচা? বা কোচ থাকাকালীন পর্যবেক্ষণ যে, মহাতারকা ক্রিকেটারও বিপন্নতার মেঘ দেখলেই স্বচ্ছন্দ পরিবেশের বাইরে যেতে ভয় পায়। এই চ্যাপেল খোলসা করলেন না। আজ তাঁর অভিজাত অনড্রাইভের দিন। পুল শটের অ্যাডভেঞ্চারের নয়। তবু চ্যাপেল চ্যাপেলই। পুরোপুরি শুধরোনোর নন! |