থমকে আছে আদালতের নির্দেশ। পুর আইন থোড়াই কেয়ার। পুড়ে যাওয়া বেআইনি অংশ ভাঙা তো হয়ইনি। বরং সেই ইমারতের উপরেই দিব্য তৈরি হচ্ছে আরও একটি তলা।
বাড়ির নাম, নন্দরাম মার্কেট।
শিয়ালদহে সূর্য সেন স্ট্রিটের বাজারে আগুন লাগার দিনেই নন্দরামে গিয়ে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হল। একটা স্ফুলিঙ্গ বা বৈদ্যুতিক গোলযোগ যে কোনও দিন ফিরিয়ে আনতে পারে পাঁচ বছর আগের সেই দিনটা।
পুর আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ছ’তলা থেকে ১৪ তলা হয়েছিল নন্দরাম মার্কেট। ২০০৮-এর ১২ জানুয়ারি উপরের সাতটি তলা আগুনে পুড়ে যায়। কিন্তু কোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও বেআইনি ওই সাতটি তলা ভেঙে ফেলা আটকাতে তৈরি হয়েছিল অদ্ভুত এক রাজনৈতিক ঐক্য। নন্দরাম মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একযোগে প্রতিরোধে সামিল হয় তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেস সবাই। সেই প্রতিরোধের মুখে তৎকালীন মহাকরণ এবং পুরভবনে বসে থাকা সিপিএম কিছুই করেনি। রাজনীতির কারবারিদের একাংশ মনে করেন, স্থানীয় সিপিএম সরাসরি প্রতিরোধে যোগ দেয়নি ঠিকই। কিন্তু বেআইনি নির্মাণের রমরমা সিপিএম নেতাদের অজান্তে হয়নি। বিরোধীরা যখন নির্মাণ ভাঙার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, সেটাকেই ঢাল করে দায় এড়িয়েছেন তাঁরা। |
নন্দরামে অগ্নিকাণ্ডের পরে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন সিপিএমের তৎকালীন দুই সাংসদ সীতারাম ইয়েচুরি এবং সুধাংশু শীল। তখন ওঁরাও ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করেই এসেছিলেন। কেন? বুধবার সুধাংশুবাবু বলেন, “আগুনের এমন অবস্থা হয়েছিল, নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছিল না। মধ্য কলকাতা অচল হয়ে যাচ্ছিল। ওই সময়ে ওঁদের আশ্বাস দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।” তা হলে পরে বেআইনি অংশ ভাঙলেন না কেন? সুধাংশুবাবুর দায়সারা জবাব, “অন্যান্য দল তো মাঠে নেমে পড়ল!”
২০০৯-এর ১ জানুয়ারি তৎকালীন বিরোধী দলনেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায় নন্দরামের ব্যবসায়ীদের প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ১২ জানুয়ারি অগ্নিকাণ্ডের বর্ষপূর্তিতে ব্যবসায়ীরা ‘কালা দিবস’ পালন করেন। সেই দিন ওঁদের সমর্থনে অকুস্থলে গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজেপি নেতা রাহুল সিংহ। সামনেই ছিল ভোট। মমতা সে দিন বলেছিলেন, ক্ষমতায় এলে ব্যবসায়ীদের ‘স্বার্থ’ দেখবেন।
তবে কি সেই ‘প্রতিশ্রুতি’ মেনেই নন্দরামে বেআইনি নির্মাণ এগিয়ে চলেছে? নন্দরাম ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক সমর চৌধুরীর অবশ্য দাবি, মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মহাকরণে নানা ভাবে তাঁর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছেন ওঁরা। “কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আমরা মুখ্যমন্ত্রীর সাক্ষাতের সময় পাইনি। তিনি আমাদের জানান, বিষয়টি দেখবেন মেয়র।” ব্যবসায়ীদের দাবি, কী করণীয় তাই নিয়ে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় কখনওই ঝেড়ে কাশেননি। কোর্টের নির্দেশ কার্যকর করে বেআইনি অংশও ভাঙেননি। এই ফাঁকতালে নন্দরামে নির্মাণ এগোচ্ছে।
কিন্তু একের পর এক অগ্নিকাণ্ড যে ভাবে কলকাতার বাজারগুলো ছাই করে দিচ্ছে, তার পরেও বেআইনি নির্মাণ চলতে দেওয়া হচ্ছে কেন? মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় এ দিন প্রকাশ্যে নন্দরামের ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়াননি। তাঁর বক্তব্য, “বেআইনি নির্মাণে আমাদের সায় নেই। নন্দরামে নিরাপত্তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। সব দিক খতিয়ে না দেখে উপরের তলাগুলো ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া যাবে না।”
স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বললেন, “নন্দরাম মার্কেট আগুনে জ্বলার পর থেকে বারবার বলছি আপনারা সুরক্ষা ব্যবস্থা ঠিক রাখুন। দু’তিনটি তলা ভেঙে দেওয়া দরকার। যদি ধসে পড়ে, মানুষ মরে যাবে। যাই হোক, নন্দরাম মার্কেটে অবশেষে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কাজ চলছে।” অনেকের মতে, মমতার এ কথার অর্থ একটাই। বেআইনি অংশ ভাঙার বাধ্যবাধকতার চেয়ে সরকার বেশি জোর দিচ্ছে নির্মাণ-সুরক্ষার উপরেই।
নন্দরামে অগ্নিকাণ্ডের পর ব্যবসায়ীদের সমর্থনে দাঁড়ানো বাকি দলগুলি এখন কী বলছে? আগুনের পর ঘটনাস্থলে গিয়ে দোকানিদের আশ্বস্ত করে এসেছিলেন কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়া। বুধবার তিনি বলেন, “আমি বলেছিলাম ওঁদের নির্মাণ আইনসিদ্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করব। কিন্তু বেআইনি নির্মাণ আমি সমর্থন করি না।” বিজেপি-র রাহুল সিংহ বলেন, “নির্মাণ বিপজ্জনক মনে হলে প্রশাসন তা ভাঙতে পারে। তার আগে প্রশাসনকে সমান সুযোগ-সুবিধা সমন্বিত বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। তার আগে ভাঙা ঠিক নয়।” রাহুলবাবুর পাল্টা অভিযোগ, “প্রশাসনের একাংশ টাকা খেয়ে বছরের পর বছর চোখ বন্ধ করে থাকবেন। কর নেবেন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে! আর বিপদ হলেই ওই ব্যবসায়ীদের বলির পাঁঠা করবেন, তা হতে পারে না।” ব্যবসায়ীরাও এই কথাই বলছেন। সমিতি সম্পাদকের যুক্তি, “৪০ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করছি। ট্রেড লাইসেন্স দিচ্ছি। ভাঙলেই হল!”
অর্থাৎ? বেআইনি নির্মাণ ভাঙার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ঐকমত্য এখনও বহাল। ফল? নন্দরাম আছে নন্দরামেই।
বুধবার দেখা যায়, বেআইনি ১৫ তলার ছাদের ঢালাইয়ের কাঠ ও বাঁশগুলো এখনও রয়েছে স্ব-স্থানে। পাঁচ বছর আগে বাড়িতে বেআইনি ও বিপজ্জনক ১২, ১৩ এবং ১৪ তলের অংশবিশেষ ভাঙার কাজ শুরু হয়েছিল। অচিরেই তা বন্ধ হয়ে যায়। এখনও রয়েছে ওই অবস্থায়। অত বড় ভবনে একটি লিফট। প্রায়ই খুঁজে পাওয়া যায় না তার চালককে। অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্রও গুটিকয়। বিভিন্ন তলে কাপড় ও দাহ্য জিনিসের স্তূপ। কোনও রকমে আগুন লাগলে ফের একই রকম ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে। |