ভোট ও অর্থনীতির ভারসাম্যই চ্যালেঞ্জ বাজেটে
র্থিক সমীক্ষা যদি বাজেট-আবহাওয়ার পূর্বাভাস হয়, তা হলে বলা যেতে পারে, কাল বাজেটে ভারসাম্যের পথেই হাঁটতে হবে পালানিয়াপ্পন চিদম্বরমকে।
লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহার একেবারে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। আবার জনমোহিনী রাজনীতির খাতিরে সম্ভব নয় আর্থিক বৃদ্ধির চিন্তা পুরোপুরি শিকেয় তুলে রাখা।
তাই অষ্টম বার বাজেট পেশ করতে যাওয়ার মুখে অর্থ মন্ত্রকের উপদেষ্টারা যতই সাহস ও ঝুঁকি নেওয়ার প্রয়োজনের কথা বলুন, চিদম্বরমের পক্ষে ’৯১ সালের মনমোহন সিংহ হয়ে ওঠা সম্ভব নয় বলেই রাজনীতির কারবারিদের মত। কিন্তু রাজকোষ ঘাটতি, মূল্যবৃদ্ধি, পড়তি লগ্নি নিয়ে চিন্তা নেই, এমন কোনও বার্তাও দিতে চান না তিনি। কারণ, আর্থিক বৃদ্ধির হার এ বছর ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ১৯৯১ সালের আর্থিক সংস্কারের পর, মাত্র চার বার এই ঘটনা ঘটেছে। মনমোহন চাইবেন না, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দ্বিতীয় ইনিংস অর্থনৈতিক আঁধারের মধ্যে শেষ হোক। কাজেই খরচের খাতায় যেখানে সম্ভব চিদম্বরম শক্ত হাতে রাশ টানবেন বলেই ইঙ্গিত মিলছে। অর্থমন্ত্রীর মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা রঘুরাম রাজনও বলেন, “আমার মনে হয় না, ভোটের দিকে তাকিয়ে বিপুল খরচসাপেক্ষ প্রকল্প ঘোষণা হবে। সরকার আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়ানোর তাগিদই দেখিয়েছে।”
আজ আর্থিক সমীক্ষায় আশার আলো দেখিয়ে বলেছে, অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত মিলছে। আর্থিক মন্দার দশা প্রায় শেষের দিকে। বৃদ্ধির হার আগামী বছরে ৬.১ থেকে ৬.৭%-এর মধ্যে থাকবে। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার গত কয়েক মাসে ফের ঊর্ধ্বমুখী। তা সত্ত্বেও পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার মার্চ মাসে নেমে ৬.২ থেকে ৬.৬%-এর মধ্যে চলে আসবে বলে সমীক্ষায় জানানো হয়েছে। রাজকোষ ঘাটতিও এ বছর ৫.৩ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব। রঘুরাম বলেন, “আমরা এখনও ভেজা উইকেটে ব্যাট করছি। চোখ ধাঁধানো স্ট্রোক নেওয়ার বদলে আপাতত একটু বুঝে ব্যাটিং করতে হবে।”
মনমোহন-সরকার যতই আশার কথা বলে শেয়ার বাজার ও লগ্নিকারীদের চাঙ্গা করতে চান, এই পূর্বাভাসকে বাস্তবে রূপ দিতে গেলে যা যা করণীয়, তার তালিকা কিন্তু ছোট নয়। সিদ্ধান্তগুলিও কঠিন। আর্থিক সমীক্ষাই বলছে, রাজকোষ ঘাটতিতে রাশ টানতে হলে খরচ কমাতে হবে। বিশেষ করে ডিজেল, রান্নার গ্যাস, কেরোসিনে ভর্তুকি কমাতে হবে। রাজকোষ ঘাটতি কমলেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমাবে। সুদ কমলে এবং বিভিন্ন প্রকল্পে দ্রুত ছাড়পত্র দিলে শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রে গতি আসতে পারে। তবেই কৃষির বাইরে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। পাশাপাশি, বিদেশ থেকে তেল, কয়লা ও সোনা আনতে প্রচুর বিদেশি মুদ্রা খরচ হচ্ছে। অন্তত সোনার আমদানি কমাতে হবে। এর সঙ্গে পণ্য-পরিষেবা কর চালু সহ একগুচ্ছ সংস্কার জরুরি।
উল্টো দিকে রয়েছে মনমোহন সরকারের যাবতীয় সামাজিক প্রকল্প। একশো দিনের কাজ, সর্বশিক্ষা অভিযান, মিড-ডে মিলের মতো প্রকল্পগুলিতে বরাদ্দ যথেচ্ছ কাটছাঁট করা সম্ভব নয়। আবার খাদ্য সুরক্ষা আইনের জন্যও আগাম কিছু অর্থ বরাদ্দ করতে হবে চিদম্বরমকে। ভর্তুকির মেদ ঝরানোর পক্ষে সওয়াল করলেও মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টারও বক্তব্য, পরিকাঠামো ও সামাজিক প্রকল্পে বেশি কাটছাঁট করলে আর্থিক স্বাস্থ্য দুর্বল হতে পারে। খাদ্যে ভর্তুকি দেওয়া প্রয়োজন বলেই রাজনের মত।
এই সব প্রকল্পের জন্য টাকার জোগাড় করার উপায় দু’টি। এক, খরচ কমানো। দুই, আয় বাড়ানো। গত জুলাইতে অর্থ মন্ত্রকের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই চিদম্বরম খরচে রাশ টানার চেষ্টা করছেন। ডিজেলের ভর্তুকি কমানোর চেষ্টা করেছেন। আয় বাড়ানোর একটি উপায় হল করের হার বাড়িয়ে আয় বাড়ানো। ধনকুবেরদের উপর করের হার বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছিল। শিল্পমহল তা খারিজ করেছে। আর্থিক সমীক্ষায় তাই করের আওতায় বেশি সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীকে আনার কথা বলা হয়েছে।
চলতি অর্থবর্ষে বৃদ্ধি ৫ শতাংশের আশেপাশে।
পরের বছর ৬.১-৬.৭ শতাংশ।
মার্চের শেষে মূল্যবৃদ্ধি নামবে ৬.২-৬.৬ শতাংশে।
এ বার রাজকোষ ঘাটতি সম্ভবত ৫.৩ শতাংশেই। আগামী বছরের লক্ষ্য ৪.৮%। ২০১৬-’১৭ সালে ৩%।
ঘাটতি কামতে সোনা ও পেট্রোপণ্যের আমদানি কমানোয় জোর।
ভর্তুকিতে রাশ। জরুরি তেল, গ্যাসের দাম আরও বেশি করে বাজারের হাতে ছাড়া।
বিদেশি লগ্নি (বিশেষত খুচরো ব্যবসায়) টানায় জোর। গতি সংস্কারে।
এই আর্থিক বছরে কমতে পারে খারিফ শস্যের ফলন।
শিল্পে সম্ভাব্য বৃদ্ধি ৩%।
বিদেশি মুদ্রার ভাঁড়ারের হাল ভাল।
রফতানিকে চাঙ্গা করতে নতুন বাজারের সন্ধান।
রাজস্ব বাড়াতে আরও বেশি মানুষকে করের আওতায় আনার ভাবনা।
জোর পরিকাঠামো নির্মাণে।
আগামী অর্থবর্ষে অর্থনীতির অন্তত কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত।
অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর, কর ছাড়ের ঊর্ধ্বসীমা হয়তো বাড়ানো হবে না। তবে আয়করে ছাড় পেতে সঞ্চয়ের ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানো হতে পারে। এখন এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়ে আয়কর ছাড় পাওয়া যায়। তা বাড়ানোর পাশাপাশি, রাজীব গাঁধী ইক্যুইটি সেভিংস স্কিমে লগ্নিও আয়করের বাইরে রাখা হতে পারে। সোনার মতোই লোভনীয় লগ্নির প্রকল্পও ঘোষণা হতে পারে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের মতে তার থেকেও বেশি জরুরি হল দেশি-বিদেশি লগ্নিকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা। রফতানি ক্ষেত্রকে চাঙ্গা করতেও কিছু পদক্ষেপ জরুরি।
শুধু শিল্পমহল, শেয়ার বাজার, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নয়, আগামী কাল চিদম্বরমের বাজেট কতখানি আর্থিক শৃঙ্খলায় বাঁধা থাকছে, তার দিকে নজর রাখবে স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর্স, মুডি’জ, ফিচ-এর মতো আন্তর্জাতিক মূল্যায়নকারী সংস্থাগুলিও। ইতিমধ্যেই তারা ভারতে বিনিয়োগ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব নিয়েছে। তাদের মূল্যায়ন আরও কমলে, বিদেশি লগ্নিকারীদের কাছে ভারত একেবারেই খরচার খাতায় চলে যাবে।
অর্থনীতির এই সব চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা কি আগামী কাল করতে পারবেন চিদম্বরম?
শিল্পমহল বলছে, চিদম্বরমের বাজেটে বরাবরই নতুন কিছু ভাবনা দেখা যায়। আগের সাত বারই তিনি বাজেটে লগ্নিকারী ও শেয়ার বাজারকে খুশি করেছেন। কোনও বারই মাত্রাতিরিক্ত কর না চাপিয়ে, কৌশলে করের পরিধি বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বাড়িয়েছেন। তিনি নির্দিষ্ট কোনও মতাদর্শ নিয়ে না চলে বাস্তবোচিত পদক্ষেপ করেন। কিন্তু পাঁচ বছর আগে শেষ বার যখন বাজেট পেশ করেছিলেন চিদম্বরম, তখন অর্থনীতির পরিস্থিতি অনেক ভাল ছিল। আর্থিক বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছিল রাজস্ব আয়। সরকারি কোষাগারের অবস্থাটাও মন্দ ছিল না। তাই ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে ৬০ হাজার কোটি টাকার কৃষিঋণ মকুব করে দিতে চিদম্বরমের কোনও অসুবিধাই হয়নি। এ বার পরিস্থিতি অনেক কঠিন।
প্রণব মুখোপাধ্যায় যেমন বিপদে পড়লে কৌটিল্যের শরণাপন্ন হতেন, চিদম্বরম তেমনই তামিল ঋষি তিরুভাল্লুভারের শরণ নেন। আগামী কাল তিরুভাল্লুভারের কোন মন্ত্র গ্রহণ করেন চিদম্বরম, সেটাই এখন দেখার।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.