রোদ-হাওয়ায় ক্ষইছে দুই প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়
রোদ, বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে মহেঞ্জোদারোর পুরাকীর্তি পর্যন্ত মাটিতে ঢেকে দিতে বলেছিল ইউনেস্কো!
সেই রোদ-বৃষ্টির দাপটেই এখন বাঁচানো দায় রাজ্যের দুই প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। সপ্তম শতাব্দীতে রাজা হর্ষবর্ধনের আমলে চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এ দেশে এসে এই দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করেন। মুর্শিদাবাদের রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের মোগলমারিতে পাওয়া একটি বৌদ্ধ বিহার। মাটি খুঁড়ে এই দু’টির সন্ধান মেলার পরে তা উপযুক্ত আচ্ছাদনের অভাবে নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে।
দু’টিই আবিষ্কারের কৃতিত্ব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের। রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার পরে অধিগ্রহণ করে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ। মোগলমারির মহাবিহারটি এখনও সংরক্ষণের আওতায় আনা হয়নি।
খোলা পড়ে রয়েছে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।
হিউয়েন সাং রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার ও তাম্রলিপ্ত এলাকার একাধিক মহাবিহারের কথা বলেছিলেন। ২০০৩-০৪ সালে মোগলমারিতে উৎখননের পরে তাম্রলিপ্ত এলাকার সেই মহাবিহারগুলিরই একটি আবিষ্কৃত হয়েছে বলে দাবি করেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপত অশোক দত্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান সুধীরঞ্জন দাসের উদ্যোগে রক্তমৃত্তিকার খোঁজ পাওয়া যায় ১৯৬২ সালে। মাটির রং লালচে। সে কারণেই এই মহাবিহারের নাম রক্তমৃত্তিকা বলে মনে করেন পুরাতাত্ত্বিকেরা।
দু’টি ক্ষেত্রেই এখন কোথাও রয়েছে সামান্য ত্রিপলের আচ্ছাদন। কোথাও খননস্থল মাটি চাপা দেওয়া রয়েছে। তবে তাতে ক্ষতি সামলানো যাচ্ছে না। জল চুঁইয়ে ঢুকে খারাপ করে দিচ্ছে প্রাচীন বাংলার দুই বিশ্ববিদ্যালয়কে। কোথাও স্থাপত্য সরাসরি রোদ-জলের মুখেই পড়ছে। কোথাও ইট খুলে নিয়ে যাচ্ছেন এলাকার মানুষ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান রূপেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, “হিউয়েন সাং কথিত এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি দু’টিই সংরক্ষণ করা দরকার। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই আর্থিক সামর্থ্য নেই। অবিলম্বে মোগলমারির মহাবিহার সংরক্ষণ করতে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।” পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের কলকাতা মণ্ডলের অধিকর্তা তপনজ্যোতি বৈদ্য বলেন, “কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রাজবাড়িডাঙায় যে খনন কার্য করেছিল, তার ছবি ও ড্রয়িংয়ের খোঁজ করছি আমরা। সেটা পেলে আমরা আরও উৎখনন করব। তাতে এখানে আরও কী কী রয়েছে, তা বোঝা যাবে।”
মোগলমারিতে বিহারের দেওয়ালের মুর্তি ও সিলমোহর। ছবি: কৌশিক মিত্র
এমনিতেই আমাদের আবহাওয়ায় পুরাকীর্তি রক্ষণাবেক্ষণ শক্ত। তার উপরে বাংলায় স্থাপত্যে পাথরের ব্যবহার ছিল কম। রূপেন্দ্রকুমারবাবু বলেন, “সপ্তম শতাব্দীতে সাধারণত স্থাপত্য তৈরি হত মাটি, চুন, সুরকি দিয়ে। তাই এমনিতেই তা খারাপ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে মাটির স্তরে চাপা পড়ে গেলে যতটুকু চাপা পড়ল, ততটুকু স্থাপত্য কিন্তু মোটামুটি রক্ষা পায়। যে কারণে চাল, মাটির মূর্তি, পাত্র অটুট অবস্থাতেও পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু উৎখননের পরে আবার বাইরে বার করে আনলে রোদ-হাওয়া-জলের সংস্পর্শে এসে তা খারাপ হয়ে যেতে পারে। তাই উৎখননের পরে তা যত্ন নিয়েই রক্ষণাবেক্ষণ দরকার।” রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতরের উপ অধিকর্তা অমল রায়ের কথায়, মাটির ভিতর থেকে স্থাপত্য বার করে আনলে তার ক্ষয়রোধের ক্ষমতা কমে যায়। তাই এ বার তা সরাসরি জল-হাওয়ার সংস্পর্শে এলে দ্রুত ক্ষয় শুরু হবে। তিনি জানান, মূল স্থাপত্যটি যদি মাটি-চুনের হয়, তা হলে যে শিল্পী তা তৈরি করেছেন, তিনি তার উপরে একটি প্রলেপ দেবেন। তা সে মূর্তিই হোক বা পাত্র। যদি স্থাপত্যটি কোনও কাঠামো হয়, তা হলে তার একটা মাটি-চুন-বালির প্লাস্টার থাকবে। এ বার তা দীর্ঘদিন মাটির নীচে থাকলে প্লাস্টার খুলে যাবে। মূর্তি হলে তার প্রলেপ নষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ তার ক্ষয়রোধের ক্ষমতাও কমে যাবে। হেরিটেজ কমিশনের পার্থ দাসও একই কথা বলেন। তাঁর বক্তব্য, সে কালে প্লাস্টারের সঙ্গে মেথি ও অন্য ভেষজ মিশ্রণ থাকত, যাতে তা ক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচানো যায়। মাটির তলায় দীর্ঘদিন থাকলে, সেই মিশ্রণের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে। তাঁর কথায়, “তাই তুলনায় মাটির নীচে থাকলে পুরাকীর্তি বরং অনেক ভাল থাকে। যে কারণে ইউনেস্কো একবার পরামর্শ দিয়েছিল, মহেঞ্জোদারোকে ফের মাটি দিয়েই ঢেকে ফেলতে।” তবে শেষ পর্যন্ত তা হয়নি, কেননা তাহলে বিরাট এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই সভ্যতার নিদর্শনগুলির পর্যটন আকর্ষণ কমে যেত। কিন্তু এ কথা ঠিক, মাটির নীচে থাকলে স্থাপত্যের গায়ে আগাছা জন্মায় না। শ্যাওলা ধরে না। কিন্তু তা বাইরে এলেই এই দুইয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া শক্ত। তাই দরকার সর্বক্ষণ নজরদারি।
তবে ছোট-বড় মূর্তি বা পাত্র উৎখনন স্থল থেকে নিয়ে গিয়ে কোনও সংগ্রহশালায় রাখা যায়। কিন্তু তা বলে আস্ত একটি প্রাসাদ বা মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষের দেওয়াল কিংবা স্তূপ কী ভাবে তুলে আনা যাবে? পার্থবাবুর মতে, “সেক্ষেত্রে গোটা এলাকাটি কোনও কাঠামো তৈরি করে ঢাকা দিয়ে দিতে হবে। যাতে কোনও ভাবেই মূল প্রত্নস্থলে হাওয়া, জলের প্রভাব না পড়ে। দরকার হলে প্রত্নস্থলগুলি ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে।” সংরক্ষণবিদদের মত, প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ হলে তা তার প্রাচীন রূপ বজায় রেখে মেরামত করাই প্রথম কাজ। সেক্ষেত্রে সেই ইট ও মশলা ব্যবহার করতে হবে। তারপরে রাসায়নিক প্রলেপ দিতে হবে তার গায়ে। যাতে ক্ষয় রোধের ক্ষমতা বাড়ে। ভিতরে লোহার খাঁচা তৈরি করতে হবে কাঠামো ধরে রাখতে। তারপরেও তাকে প্রয়োজনে ঢাকা দিয়েই রাখতে হবে।
রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতর অবশ্য ইতিমধ্যেই মোগলমারির প্রত্নক্ষেত্রটি সংরক্ষণের জন্য ৫০ লক্ষ টাকা ও সংগ্রহশালা নির্মাণের জন্য ৩০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছে। রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতর পঞ্চায়েত সমিতির আর্থিক সহায়তায় বিশেষজ্ঞদের পাঠিয়ে সেখানে দেওয়ালে সংলগ্ন চুন-বালির তৈরি মূর্তি সংরক্ষণ করেছে। অমলবাবুর কথায়, “আমরা সংরক্ষণের কাজ শুরু করে দিয়েছি। মোগলমারিতে চুন-বালির প্লাস্টার পাওয়া গিয়েছে। তাই তা সংরক্ষণ আরও বড় চ্যালেঞ্জ।” তিনি বলেন, “ওই প্রত্নস্থলকে সংরক্ষিত এলাকা বলে ঘোষণা করতে প্রাথমিক বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন আমাদের সাহায্য করছে।”

অরক্ষিত ধ্বংসাবশেষ
রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার
• চারটি স্তরে মোট পাঁচটি পর্বের বসতির নির্দশন। একটি বৌদ্ধবিহারের মেঝে, সিঁড়ি ও গোলাকার স্তূপের ভিত, একটি শস্যভান্ডার পাওয়া গিয়েছে। তৃতীয়-চতুর্থ শতাব্দীর এক বিশ্ববিদ্যালয় গৃহের সন্ধান মিলেছে।
মোগলমারি মহাবিহার
• পাওয়া গিয়েছে বৌদ্ধ বিহার। চারিদিকে ছিল প্রদক্ষিণপথ। বাইরে উঁচু প্রাচীর। বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি মিলেছে।

• সিদ্ধমাত্রিকা হরফে পোড়ামাটির সিলমোহর।
হিউয়েন সাং
• হর্ষবর্ধনের আমলে ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে চিন থেকে ভারতে এসেছিলেন এই বৌদ্ধ পরিব্রাজক। বুদ্ধের স্মৃতি জড়িত বা বৌদ্ধ সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্রগুলিতে গিয়েছিলেন তিনি। সেই সূত্রেই এসেছিলেন তাম্রলিপ্ত ও কর্ণসুবর্ণে। তাম্রলিপ্ত সম্পর্কে তাঁর মত, মানুষ একটু কড়া ধাতের। সাহসী। বেশ বড়লোক। জলবায়ু উষ্ণ। তবে জমি নিচু, জল-কাদা মাখা। তাতে চাষ হয় ভাল। ফল, ফুলও প্রচুর। তাম্রলিপ্ত এবং তার আশপাশ নিয়ে বিরাট এলাকায় ছিল অনেক মঠ-মন্দির ও মহাবিহার। কর্ণসুবর্ণের মানুষ বেশি ধনী। জমি একইরকম। তবে মানুষ বেশ নরম স্বভাবের। শিক্ষায় মনও বেশি। শহরের কাছেই ছিল সুবিশাল রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার।

তথ্য সহায়তা শুভাশিস সৈয়দ ও অমিত কর মহাপাত্র।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.