|
|
|
|
|
|
|
একটাভয়কষ্টলজ্জা[ঘেন্না] |
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় |
দাদা, একটু সাইড দেবেন?’ শুনে হতদরিদ্র, ছেঁড়া লুঙ্গি পরা কঙ্কালসার চেহারার বছর পঞ্চান্নর এক মানুষ নিজের হাতে ধরে থাকা নিজের স্যালাইনের বোতলটা কাঁপা কাঁপা হাতে আঁকড়ে আরও একটু কুঁজো হয়ে কোনও মতে আমায় যাওয়ার পথ করে দিলেন, ভেতরে— সরকারি হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ঢোকার পথে। তত ক্ষণে মাড়িয়ে এসেছি মাটিময় পড়ে থাকা দলা দলা বমি, পাশ কাটিয়েছি ডাঁই হয়ে থাকা পুঁজরক্তমাখা তুলো আর ব্যান্ডেজের রোল, স্ট্রেচারে আর মাটিতে শোয়ানো রুগির দল। মাথা ঝিমঝিম করছে, চার দিকে ঘিরে ধরছে উগ্র ফিনাইলের গন্ধ, মলিন টিউবলাইটের আলো। বিভিন্ন দরজা-জানলায় টাঙানো ছেঁড়াখোঁড়া পর্দা, তেলচিটে দেওয়াল যে কত বছর রং হয়নি তার ইয়ত্তা নেই। আর সেই দেওয়ালে লেগে রয়েছে টাটকা থুথু, গুটখার পিক, হলুদ তরল, ছিটে ছিটে রক্ত। আমার লক্ষ্য, কোনও মতে ভেতরে গিয়ে আমার অসুস্থ আত্মীয়কে দেখে আসা, তাঁর চিকিত্সা যাতে দ্রুত হয় সেই ব্যবস্থা করা। কিন্তু সেই অবধি পৌঁছতেই তো আমার পেটের সব ভাত উঠে আসছে। সত্যি বলছি, যেখানে প্রাথমিক অনুভূতি হওয়া উচিত ছিল কষ্ট, সেখানে আমার প্রথম এবং সর্বাঙ্গ-জোড়া অনুভূতি হল ঘেন্না।
খুব বমি পাচ্ছিল। নিজেকে খুব সামলানোর চেষ্টা করছিলাম, নিজেকে তিরস্কারও করলাম বহু বার— এ কী! এ কী রকম মানুষ তুই, যেখানে এতগুলো লোক কষ্ট পাচ্ছে আর ঠিক চিকিত্সা পাচ্ছে না, সেখানে এদের প্রতি সমবেদনা জন্মাবার বদলে তোর স্রেফ ইচ্ছে করছে এই জায়গাটা ছেড়ে ছুট লাগাতে! কিন্তু উচিত-কাজ ব্যাপারটা ব্রেন যতটা বোঝে, হৃদয় ততটা বোঝে না। হাসপাতালের তীব্র বাস্তবের চোটে, নিজেকে অতিক্রম করে অন্যের জন্য ফিল করতে পারিনি। বার বার মনে হচ্ছিল— এই নোংরা মেঝে, নোংরা বিছানা, ময়লার স্তূপ, খোলা সিরিঞ্জ, কোথাও ছুরি-কাঁচি রাখার জায়গা খোলা পড়ে, কোথাও রক্ত রাখার খালি প্লাস্টিক পাউচ আর সেটা কেউ মাড়িয়ে দেওয়ায় দু-চার ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে মাটিতে শুকিয়ে রয়েছে— কোথায় যাব, ডান দিক গেলে চাপ চাপ ঘেন্না, বাঁ দিক গেলে চাপ চাপ ঘেন্না।
নাক চেপে কোনও মতে বাইরে এসে দাঁড়াতেই দেখলাম পাশের বিল্ডিং থেকে ঝুলছে ছেঁড়া, তুলো-বেরনো বালিশ, চাদর, প্রাত্যহিক কিছু নোংরা, ব্যবহার করা ন্যাপকিন। এবং একটা লম্বা চাদরে ভর করে এই নোংরার ধারা নেমে এসেছে তিন তলা থেকে এক তলায়, হিসি-পায়খানা আর ফিনাইলের মিলিত গন্ধে চত্বর ম ম।
আমার তখন একটাই টার্গেট— কী করে পালাই। এই দুর্গন্ধ, এই জ্যাবজেবে নোংরা যেন আমার চামড়ার ভেতর দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল বাড়ি গিয়ে চার বার স্নান করলেও ময়লাগুলো উঠবে না। চা খেতে গেলাম এক বার, পারলাম না। নাক দিয়ে ভেতরে বসে গিয়েছে গন্ধটা। ঢেকুর উঠে এল এই গন্ধটা নিয়ে। বাপরে বাপ! আত্মীয় ভাল হয়ে এলে বাড়িতে দেখতে যাব’খন, সব সিমপ্যাথি তখনকার জন্যে তোলা থাক, অফিসের অজুহাত দেখিয়ে এই চত্বরের আর মাইলটাকের মধ্যে আসিস না মা— নিজেকে এই উপদেশ দিয়ে, হনহন করে ট্যাক্সি ধরলাম। হয়তো আমি খুব অ-সহিষ্ণু। নিজেকে সামলানোর ক্ষমতা নেই। কিন্তু তত্ত্বকথা দিয়ে এই ঘেন্নাটা ধুতে পারি না। এখনও। স্পেশালি যখন ভাত খেতে বসি। |
|
|
|
|
|