|
|
|
|
|
|
|
সুমনামি |
কবীর সুমন
|
উনিশ শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে আধুনিক বাংলা গানের ইন্ডাস্ট্রিতে এক অভূতপূর্ব জোয়ার এসেছিল। তার একটা কারণ সম্ভবত— কুড়ির দশকে ম্যানুয়াল রেকর্ডিং পদ্ধতির জায়গায় বৈদ্যুতিক রেকর্ডিং এসে পড়ায় গ্রামোফোন কোম্পানিগুলির উত্পাদন ক্ষমতা অনেকটা বেড়ে যায়। ফলে গান-পণ্য সরবরাহের জন্য এই পণ্যের নির্মাতাদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে আগের চেয়ে বেশি। সেই প্রয়োজন মেটাতে বেশ কিছু সৃষ্টিশীল মানুষকে কী কারণে ক্রমান্বয়ে পাওয়া গেল এবং ষাটের দশকের পর তাঁদের সংখ্যা লক্ষণীয় ভাবে কমেই বা গেল কেন, এই জরুরি প্রশ্নের যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর পাওয়া মুশকিল।
চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের সুরকারদের কথা ভাবলে তাক লেগে যায়। সুর-তাল-ছন্দের দিক দিয়ে সে-যুগের আধুনিক বাংলা গানের যে বৈচিত্র, কথার দিক দিয়ে তা কিন্তু ছিল না। বেশির ভাগ গানের বিষয়ই ছিল প্রেম— তাও আবার অসহায়-আকুতিমূলক। এ ছাড়া ছিল সাজানো দুঃখ, গোছানো সুখ। সেই সঙ্গে ছিল ক্রিয়াপদের সাধু-চলিত রূপের বিরক্তিকর সহাবস্থান। ‘গো’ আর ‘ওগো’র উপস্থিতিও আমার বেখাপ্পা লাগত। চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট এবং সত্তরের দশকেও আধুনিক বাংলা গানের সুর শুনে পাগল হয়ে যেতাম। কথা শুনে ফিরে আসতাম সম্বিতে। একই কারণে, লিরিকের দুর্বলতা, অনাধুনিকতার জন্য রবীন্দ্রনাথেরও কিছু গান এবং কাজী নজরুল ইসলামের অনেক গান, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত ও অতুলপ্রসাদের অধিকাংশ গান আমার ভাল লাগেনি, লাগে না।
আধুনিক বাংলা গানের সুর শুনে বুকে রক্তক্ষরণ হত। গানের কথা, লিরিক ছিল দক্ষ ডাক্তার। অচিরেই ক্ষত সারিয়ে দাঁড় করিয়ে দিত আমায় জীবনের পথে। পরে, ভাবনাচিন্তা করে মনে হয়েছে, কথাগুলো অনেক সময়ে অকিঞ্চিত্কর ছিল বলেই সুর-শৈলী প্রাধান্য পেয়েছিল। গানের কথার দুর্বলতা, লিরিক-শৈলীর আব্বুলিশ-আব্বুলিশ ভাবকে সহনীয় করে তুলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, গানের কথা আর কবিতার কথা এক ‘তুলাদণ্ডে’ ওজন করা ঠিক নয়। প্রথমটি শোনার জন্য, দ্বিতীয়টি পড়ার জন্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যা-ই বলুন, শুনতে গিয়েও যে খটকা লাগে, বা সোজা কথায় বাজে লাগে।
যেমন, ব্যাঙের সঙ্গম-অভিলাষকে আমি আমার নিজের সঙ্গমেচ্ছার সঙ্গে এক খাটে বসিয়ে বা শুইয়ে ‘আমিও একাকী তুমিও একাকী’র বিরহ ও বাদলরাতের নিঃসঙ্গতার মাঝমধ্যিখানে ‘ডাকিছে দাদুরি মিলন-পিয়াসে’— এই রূপকল্প-কে মেনে নিতে নারাজ। আমার প্রতিবেশী দাদুরি বর্ষার রাতে বায়োলজির কারণে তাঁর প্রিয়কে যতই ডাকাডাকি করুন, বিরহকাতর এই আমার দেহমনের বেহাল অবস্থার সঙ্গে বেহাগ রাগের ভাবগম্ভীর মাধুর্যে সেই গ্যাঙরগ্যাঙ-কে মিলিয়ে দিতে আমি কিছুতেই রাজি নই।
ব্যাং বা রামছাগলের বিরহ পর্যন্ত অত দূর না গেলেও তথাকথিত আধুনিক বাংলা গানের লিরিকের চিত্রকল্প, ভাষা অনেক ক্ষেত্রেই অনাধুনিক থেকে গিয়েছিল। প্রেম আর প্রেমসংলগ্ন প্রকৃতি, যেমন নদীর বালুচর, চাঁদের আলো, সাগরের ঢেউ, বলাকার পাখা, কাকলি কূজন, ভ্রমরের মধুগুঞ্জন, দক্ষিণের হাওয়া (যা থেকে থেকেই উতল), রোদ (যা প্রায়ই ‘সোনারোদ’), মেঘ ইত্যাদির বাইরে আধুনিক লিরিক বেরোতেই পারছিল না। তারই মধ্যে মোহিনী চৌধুরী, শ্যামল গুপ্ত, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, বিমল ঘোষ, মুকুল দত্তের কোনও কোনও লিরিক ব্যতিক্রম। কিন্তু সাধারণ ভাবে আধুনিক বাংলা গানের লিরিকের প্রবণতা ছিল অনাধুনিকতা ও ‘সাবেকিয়ানা’র দিকে। চমত্কার রিদম গিটার সহযোগে, ব্যালাডের আঙ্গিকে আধুনিক গান বাঁধতে গিয়েও গান-বিধাতা সলিল লিখে ফেলেছেন: ‘মোর মানসী কলসি কাঁখেতে লইয়া ওখানে দাঁড়াত এসে’। সমকালীন মন যে যেতে চায় একগাছি দড়ির খোঁজে। অনেক বছর পরে বিধাতাকে এটা বলেছিলাম। হাসতে হাসতে বিষম খেয়েছিলেন তিনি।
সময়ের সঙ্গে সমাজে, সমাজজীবনে, ব্যক্তিজীবনে কত কী পাল্টে গেল। আধুনিক কবিতায়, গদ্যে, কাহিনিতে, নাটকে, চলচ্চিত্রে তার প্রভাব পড়ল। আধুনিক বাংলা গানে পড়ল না। |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
এই রকমই চলছে, কোনও বাংলা গানের সঙ্গেই আর মেলাতে পারছি না নিজেকে, এমন একটা সময়ে বেতারে এক দিন শুনলাম একটি আধুনিক গান: ‘এ কেমন রাত পোহাল, দিন যদি আর এল না’। তত দিনে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং অংশুমান রায়ের একটি মাত্র গান ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আর কোনও গানই বানাতে পারেননি পশ্চিমবঙ্গের কেউ। পশ্চিমবঙ্গে নকশালবাড়িতে অভ্যুত্থান হয়ে গিয়েছে, নকশালপন্থীরা চ্যালেঞ্জ করেছেন রাষ্ট্রকে, রাষ্ট্র তাঁদের মোকাবিলা করছে কঠোর ভাবে। খুন তখন নিত্য ঘটনা। আমার সহপাঠী তিমিরবরণ সিংহ শহিদ হয়েছেন। শহিদ হয়েছেন অনেক তরুণ-তরুণী। তেমনই নকশালরাও পুলিশের চর সন্দেহে কাউকে খুন করেছেন, জোতদার নিধন করেছেন এমন খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
অফিস যাচ্ছি। গালে দাড়ি, পরনে গেরুয়া পাঞ্জাবি আর ধুতি। যাদবপুরের এইট-বি বাসস্ট্যান্ডে হঠাত্ মাটি ফুঁড়ে উঠে আসছে সাদা পোশাকে পুলিশ। ক্ষিপ্রগতিতে পিস্তল বের করে আমার পেটে ঠেকিয়ে শান্ত ভাবে বলছে: ‘কী রে শুয়োরের বাচ্চা, তোর মা-র সঙ্গে কে শুয়েছিল তোকে পয়দা করার জন্য— মাও, না হো চি মিন?’। কী অসামান্য কেরামতি লোকটার! নকশালপন্থী বন্ধুরা, মাওয়ের রচনা, চে-র রচনা যা পারেনি, এই লোকটা তা পেরে গেল এক লহমায়— নকশালপন্থীদের সমর্থক হয়ে গেলাম আমি সেই মুহূর্ত থেকে। রাজনৈতিক ক্ষমতা বন্দুকের নল থেকে বেরিয়ে আসে। একটু দূরেই দেওয়ালে লেখা মাও-এর উক্তি। প্রমাণ করে দিল এ দেশের পুলিশ। ‘আজি কোন সুরে বাঁধিব?’ কোন রাগ, কোন তাল, কোন বাংলা গান ধরতে পারবে আমার জীবনের এই মুহূর্ত? কোন রবীন্দ্রনাথ? কোন সলিল?— সকালে বেতার অনুষ্ঠানে শান্ত গলায় কে গাইছেন—
‘এ কেমন রাত পোহাল দিন যদি আর এল না
কেন এ অন্ধ আকাশ নতুন আলোয় পথ পেল না’।
জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। তাঁরই লেখা, অশোক রায়ের সুর। এই প্রথম একটা বাংলা গান শুনছি, যার সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারছি। শহিদ সহপাঠী তিমিরের মুখ।
সক্কালবেলা বাড়ির কাছে খাল দিয়ে ভেসে যাচ্ছে যুবকের লাশ। অফিস যাওয়ার পথে দেখছি। বেতারে শুনছি ভাটিয়ার রাগে জটিলেশ্বর গাইছেন: ‘এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার’। মিথ্যে বলব না, ‘পাখির কূজন’ কথাটিতে ঠোক্কর খেলাম, কিন্তু সব মিলিয়ে মনে হল— এই সময়ের গান। আমার গান। বৈঠকি চালে বাঁধা গানগুলি। স্ট্রাকচারে লক্ষণীয় নতুনত্ব নেই। কিন্তু সনাতন চলনে, স্থায়ী-অন্তরা-সঞ্চারী-দ্বিতীয় অন্তরার কাঠামো এবং আধুনিক গানের সুরছন্দগত ধারাবাহিকতায় থেকেও যে যুগোপযোগী বাংলা গান বাঁধা যায় ও গাওয়া যায়, জটিলেশ্বর, একমাত্র জটিলেশ্বর তা দেখিয়ে দিলেন সত্তরের দশকের প্রথম দিকেই। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ছাত্র। গুরুর পথেই ছোট কাজগুলি করছেন কোনও রকম কালোয়াতি না দেখিয়ে। কী নম্র, কী স্নিগ্ধ তাঁর কণ্ঠের চলন!
‘কেউ বলে ফাল্গুন কেউ বলে পলাশের মাস’ তো হয়ে উঠেছিল গানে-লুকোনো আমারই প্রেমের আর্তি।
‘আমি তো তাকে কোনও নামে ডাকিনি
সে যে আমার চোখেই জলোচ্ছ্বাস’
এক দিন বয়ে এনে দিতে পেরেছিল রহস্যমাখা এক বিষণ্ণতার গন্ধ আমার চব্বিশে— যেন এক অপরিচিতার নিশ্বাস। আজ, আমার চৌষট্টিতেও এই গান সামান্য গুনগুন করলেও হয়ে যায় আমার এই বয়সের নাছোড়বান্দা প্রেমের আকুতি। মরে যেতে ইচ্ছে করে। এই ইচ্ছেটার পেছনে যিনি আছেন, তাঁর বয়স আশি বছর হল। আশি বার আদর করছি তাঁকে আমরা: সে, আমি আর আমার গিটার। |
|
|
|
|
|