রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ১...
কনল্যাং
বাইবেলের জেনেসিস-এ আছে, আগে মানুষ একটাই ভাষায় কথা বলত। তার পর মানুষ যখন ঈশ্বরের উচ্চতায় পৌঁছনোর জন্য উঁচু মিনার গড়া শুরু করল, ঈশ্বর সেই প্রোজেক্ট নষ্ট করার জন্য গুলিয়ে দিলেন তার মুখের ভাষা। ব্যস, মাটি থেকে শিখর পর্যন্ত মিনারের অ্যাত্তগুলো ধাপে কাজ করছে অগুনতি লোক, কিন্তু কেউ এক বর্ণ বুঝতে পারছে না অন্যে কী বলছে। হতাশ মানুষগুলো অত সাধের টাওয়ারিং প্রোজেক্টটাই ছেড়ে চলে গেল যে দিকে দু’চোখ যায়। এক এক ভাষার মানুষ ছড়িয়ে গেল পৃথিবীর এক এক দিকে, প্রান্তে। ঈশ্বর মুচকি হেসে পাশ ফিরে শুলেন।
কিছু মানুষ ছিলেন, আছেন এখনও, ঈশ্বরের এই ব্যঙ্গ-হাসি মুছিয়ে দেওয়া যাঁদের উদ্দেশ্য। তাঁরা বানাতে চান আনকোরা নতুন এক ভাষা, যে ভাষায় সব্বাই কথা বলবে। তাঁরা আবিষ্কার করতে চান একটা গোটা ভাষা, সেই ভাষার নাম থেকে শুরু করে এক একটা অক্ষর, বর্ণ, ব্যাকরণ, অভিধান— সব, সমস্ত। কেন? অগুনতি ভাষার চল তো আছেই পৃথিবীতে। প্রত্যেকটা ভাষাই নিজের মতো করে চমত্‌কার, আশ্চর্য। হাজার হাজার বছর ধরে লক্ষকোটি মানুষ এই সব ভাষায় কথা বলছে, লিখছে, ঝগড়া করছে, ভালবাসছে। এগুলোকেই ভাষাতাত্ত্বিকরা বলেন ‘ন্যাচারাল ল্যাংগোয়েজ’, অসংখ্য বছর ধরে যারা আপনাআপনি, প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে, বেড়ে উঠেছে। কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, এই সমস্ত ভাষাই নানা অনিয়ম-বেনিয়মে ভরা, তাদের বয়ে চলা কি হঠাত্‌ দাঁড়িয়ে পড়া নেহাত খামখেয়াল, বেশ কিছু ব্যাপার যুক্তিরহিত, এমনি-এমনিই, প্রচলিত বলেই শুদ্ধ। আরও ভাবার: পৃথিবীর এত মানুষের এত মুখের ভাষার কোনওটাই কি অমোঘ, অব্যর্থ ভাবে বোঝাতে পারে যে ভাবনাটা ভাবছি তার একশো শতাংশ? যা-ই বলি না কেন, একটা ফাঁক থেকে যায় কোথাও, শব্দগুলো আবেগকে বা ভাবনাকে গোটাগুটি বোঝাতে পারে না কিছুতেই, ভালবাসা আর ‘ভালবাসি’ শব্দটা বলায় যে তীব্রতার তফাত, তা থেকে যায় সর্ব ক্ষণ। কিছু মানুষ, যুগে যুগে, দেশে দেশে, এই ফাঁকটুকু পূরণ করার পণ করেছেন। এঁরা বানাতে চান এমন ভাষা, যা নিখুঁত। বিজ্ঞানসম্মত, গাণিতিক ভাবে তৈরি। এই রকম ‘আবিষ্কৃত’ ভাষা পৃথিবীতে আছে প্রায় ৯০০টি! মানুষের হাতে-গড়া কৃত্রিম এই ভাষাদের বলে ‘কনস্ট্রাক্টেড ল্যাংগোয়েজ’ (সংক্ষেপে ‘কনল্যাং’), আর এই মানুষদের পরিচিতি ‘কনল্যাংগার’ নামে।
এই ন’শোটা ভাষাই একান্ত ব্যক্তিগত বা দলবদ্ধ সচেতন প্রয়াস। কিছু ভাষা গড়তে অবশ্য নানান ন্যাচারাল ল্যাংগোয়েজের (যেমন ল্যাটিন, ইংরেজি) ধাঁচা বা নির্যাসটুকু ধার নেওয়া হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ কন্ল্যাং-ই একেবারে নতুন, শুরু থেকেই একদম আলাদা, অভিনব। এত কাজ থাকতে কেন এই ‘ভাষা তৈরি’র উদ্ভট খেলায় মন দেওয়া? কেউ বলেছেন, আমার ইচ্ছে, শখ। কেউ ভাষা তৈরি করেছেন ঈশ্বরের সঙ্গে মরমি যোগসাধনের জন্য। কেউ ভাষা বানিয়েছেন গানে-নাটকে-সিনেমায় ভাবের গভীরতর স্তর যোগ করতে, বা নেহাত নিরীক্ষার আনন্দে।
সতেরো শতকে বেকন, দেকার্ত্ বা লাইবনিত্‌স-এর মতো দার্শনিকরা মনে করতেন, মাতৃভাষা বা যে কোনও দেশের-সমাজের ন্যাচারাল ল্যাংগোয়েজই মানুষের চিন্তাভাবনাকে কেমন একটা জট পাকিয়ে ঘুলিয়ে দেয়। তার চেয়ে ঢের ভাল কৃত্রিম, ‘আর্টিফিশিয়াল’ একটা ভাষা তৈরি করা, যা বুঝবে বিশ্বের সব মানুষ, যে ভাষা হবে অদ্বিতীয়, সহজে শেখার মতো, রাজনৈতিক ভাবে নিরপেক্ষ, যে ভাষা মেলাতে পারবে গোটা পৃথিবীকে। বলা বাহুল্য, এমন ভাষা তৈরি হয়নি। কিন্তু মানুষও থেমে থাকেনি। আগেকার যুগে, সবাইকে মেলানোর জন্য না হোক, ধর্মসাধনার অঙ্গ হিসেবে সে নিজস্ব ভাষা আবিষ্কার করেছে। বারোশো শতাব্দীতে এক জার্মান সন্ন্যাসিনী হিলডেগার্ড বানিয়েছিলেন ‘লিংগুয়া ইগনোটা’ (অর্থ ‘অজানা ভাষা’) নামে মিস্টিক ভাষা। পাওয়া যায় এ ভাষার তেইশটা অক্ষর, আর তা দিয়ে বানানো অন্তত ১০১১টা শব্দের একটা গ্লসারি, সেখানে aigonz (ঈশ্বর) থেকে inimois (মানুষ) হয়ে পরিবারের সম্পর্কবাচক শব্দগুলোও সব আছে, মায় সত্‌মা-বাবা অব্দি।
১২৭৫ সালের স্পেনে দার্শনিক-লেখক র্যামন লুল ‘আর্স ম্যাগনা’ নামে এক ইউনিভার্সাল ল্যাংগোয়েজ প্রোজেক্ট চালু করেন, উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তর করা। দু’টো বা অনেকগুলো কাগজের চাকতির ওপর ঈশ্বরের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলির পরিচায়ক কিছু অক্ষর-প্রতীক লিখে-এঁকে, চাকতিগুলো ঘুরিয়ে পারমুটেশন-কম্বিনেশন পদ্ধতিতে তিনি বের করেন ঈশ্বর-বিষয়ক যাবতীয় সত্য। তর্কশাস্ত্র, যুক্তি আর ধর্মবিশ্বাসের মিশেল এই ভাষাকে দিয়েছিল পৃথিবীর প্রথম ‘ইনফর্মেশন সায়েন্স’-এর গৌরব। ফ্রান্সের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গেলে দেখতে পাবেন ‘বালাইবালান’ ভাষার অভিধান। ষোড়শ শতকের তুর্কি গুলসেনি সম্প্রদায়ের দরবেশ মুহি-ই-গুলসেনির বানানো এই ভাষার শব্দভাণ্ডারে ছিল মিশ্র ফারসি, তুর্কি আর আরবি, ব্যাকরণে ছিল তুর্কির প্রভাব। খুব সম্ভবত আল্লাহ্র সঙ্গে অন্তরঙ্গ, একান্ত আলাপচারিতার ভাষা ছিল এটি, প্রচারের আলো থেকে দূরে স্বেচ্ছায় অন্তরিন হয়ে ছিল গুপ্ত সাধক-সঙ্ঘের বৃত্তে।
এখনকার দুনিয়ায় কনল্যাংগার-রাঅবশ্য ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগে খুব উত্‌সাহী নন, কিন্তু ঘরে বা অফিসে বসে বছরের পর বছর প্রবল পরিশ্রমে তাঁরা ভাষা তো বানাচ্ছেনই, এ নিয়ে চর্চা ও প্রচারেরও কমতি নেই। নতুন নতুন ভাষা তৈরির সুলুকসন্ধান করতে আছে আন্তর্জাতিক সংস্থা, নাম ‘ল্যাংগোয়েজ ক্রিয়েশন সোসাইটি’। নিয়মিত হচ্ছে ‘ল্যাংগোয়েজ ক্রিয়েশন কনফারেন্স’ও। পঞ্চম কনফারেন্সটা বসছে আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহে, আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন ক্যাম্পাসে। ২০০৬-এ বার্কলেতে বসে প্রথম সভা, আলোচনা হয় কোনও নির্দিষ্ট একটি বা একাধিক কনল্যাং নিয়ে নয়, ভাষা সৃষ্টির বিষয়টা, তার খুঁটিনাটি, নীতি প্রণয়ন, ভাষার সমাজতাত্ত্বিক-দার্শনিক প্রভাব, এই সব নিয়ে। পরের বছর দ্বিতীয় কনফারেন্স ব্যাপক হিট, হাজির হন বহু কনল্যাংগার, নিজের নিজের ভাষা নিয়ে। এই সম্মেলনেই ‘স্মাইলি অ্যাওয়ার্ড’ পায় ‘ইথকুইল’ নামের ভাষাটা, স্রষ্টা আমেরিকার জন কুইজাদা।
এই মানুষটি শৈশব থেকেই ভাষা নিয়ে খেলতেন। ফরাসি রক ব্যান্ড ‘ম্যাগমা’-র পাগলাটে গায়ক ক্রিস্টিয়ান ভেন্ডার-এর গলায় উদ্ভট আজগুবি একটা ভাষার গান শোনেন এক দিন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, এ রকম কোনও ভাষা আদৌ নেই, এটা ভেন্ডারেরই বানানো, ভাষাটার নাম ‘কোবাইয়ান’। ভেন্ডার এটাকে বলেন ‘মেলোডিক এলিয়েন ভাষা’, ‘এলিয়েন’ কারণ, তা অন্য কোনও মানুষের জন্য বানানো নয়, শুধু নিজের অনেক গান বাঁধতে বানানো। (জীবনমুখী ব্যান্ডরা চেষ্টা করে দেখতে পারেন, হয়তো এই কনফারেন্সের জলসায় বরাত পাবেন!) সেই প্রথম অনুপ্রেরণা, কুইজাদা মনপ্রাণ ঢেলে দেন নিজের হাতে একটা ভাষা বানানোর সাধনায়। পনেরো বছর বয়সেই তৈরি করেন ‘মবোজো’, তার ভোকাবুলারির অনেকটাই অন্য কয়েকটি ভাষার সংকর, আর ধ্বনিতত্ত্বে আফ্রিকান ভাষার ছোঁয়া। কিছু দিন পর বানান আরও একটা ভাষা, নাম ‘সেকজ’। এর শব্দভাণ্ডারের অনেকটাই আবার বানানো হয়েছিল টাইপরাইটারে এলোমেলো যা ইচ্ছে তা-ই বর্ণগুচ্ছ টাইপ করে।
তা বলে ভাবলে ভুল হবে কন্ল্যাংগিং মানেই খামখেয়ালিপনা, এ ভাষা ও ভাষা থেকে খামচে খাবলে নিয়ে, বা মনে হাতে যা এল তা-ই আগডুম বাগডুম লিপিতে লিখে সেটাকে নতুন ভাষা বলে চালিয়ে দেওয়া। আদৌ তা নয়। তার নির্দিষ্ট তত্ত্ব, যুক্তি থাকতেই হবে। গোটা ব্যাকরণ বানাতে হবে! ‘ইথকুইল’ বানাতে কুইজাদা বছরের পর বছর অক্লান্ত খেটেছেন, লাইব্রেরিতে দুনিয়ার যত বিচিত্র ভাষার ওপর গবেষণাধর্মী বিস্তর লেখা পড়ে নোট নিয়েছেন, বহু বিরল ব্যাকরণের নিয়মকানুন মকশো করেছেন।
ধরুন, অস্ট্রেলীয় আদিবাসীদের ভাষা ‘গুউগু য়িমিথির্’-এর ব্যাকরণে ‘বাঁ-ডান-সামনে-পিছনে’ জাতীয় কোনও নির্দেশ-সূচক শব্দ নেই, আছে শুধু উত্তরদক্ষিণপূর্বপশ্চিম। তাই বাঁ/ডান পা না বলে, বলতে হয় উত্তর/দক্ষিণ পা। আবার উত্তর-পশ্চিম প্যাসিফিকের ‘ওয়াকাশান ইন্ডিয়ান’দের ভাষায় একটা বাক্য ব্যাকরণসিদ্ধ হবে শুধু তখনই, যদি সেটা পষ্টাপষ্টি বুঝিয়ে দিতে পারে: যে কথাটা বলা হচ্ছে সেটা বক্তা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় জানতে পেরেছে, না অনুমান করছে, না স্রেফ গুজব শুনেছে। এইগুলো বোঝাতে ওঁদের আলাদা আলাদা ক্রিয়াপদের রূপ রয়েছে! এই সব পড়ে কুইজাদা ঠিক করলেন, সব ভাষাগুলোর ভাল দিকগুলো জুড়ে জুড়ে ‘ইথকুইল’ হয়ে উঠবে এমন এক ভাষা, যা দিয়ে মানুষের মনে বুড়বুড়ি-কাটা ভাবনাগুলো চরম সোজাসাপটা তরিকায় প্রকাশ করা যাবে। অনেক বার পাল্টে পাল্টে তিনি ২০১১-য় ভাষাটার নবতম (এবং সম্ভবত শেষ) সংস্করণ পেশ করেছেন, তাতে আছে শুধু ক্রিয়াপদেরই খান বাইশ ভাগ, হাজারের বেশি সাফিক্স, সঙ্গে ব্যাকরণের নিয়মিত বিভাগগুলো তো বটেই! এত জটিলতা পেরিয়েও ইথকুইল-এর আজ বিরাট নামডাক, ফেসবুকে আছে ‘ইথকুইল পেজ’, কমিউনিটিও, সেখানে ভক্তেরা ওই ভাষায় পোস্ট করেন প্রার্থনা-শ্লোক, বা ‘ইথকুইল উইজডম অফ দ্য ডে’।
১৮২৭ সালে ফ্রাঁসোয়া সুদরে বানিয়েছিলেন অসাধারণ একটি মিউজিক্যাল কন্ল্যাং, নাম ‘সলরেসল’। এ ভাষায় সাতটি মাত্র মৌলিক ধ্বনি/স্বর। তাদের প্রকাশ করা যায় অনেকগুলো উপায়ে: পশ্চিমি সপ্তকের সাত স্বর ‘ডো-রে-মি-ফা-সল-লা-সি’ দিয়ে, বা রামধনুর সাত রঙে, আবার এক থেকে সাত অবধি সংখ্যায়, এমনকী হাতের মুদ্রা দিয়েও। তার মানে, মজার এ ভাষায় সংযোগসাধন সম্ভব মুখে বলে, সুর গেয়ে, ছবি এঁকেও! কড়া বাপের সুন্দরী মেয়েকে প্রোপোজ করতে ‘তোমাকে ভালবাসি’ সুরটা ওদের বাড়ির সামনে শিস দিতে দিতে হাঁটলেও হল, চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙার ভঙ্গিতে সাইন ল্যাংগোয়েজেও বলা যায়, আবার ওদের সিংদরজায় লাল নীল বেগুনি হলুদ লাইন ঁকে পালিয়ে গেলেও হল, প্রেমিকার বাবা ধরলে বলতে হবে জোকার আঁকছিলাম, ইনকমপ্লিট আছে!
তৈরি-ভাষার মধ্যে একটার নাম আমরা সবাই জানি: এসপেরান্টো। ১৮৮৭-তে ইহুদি ডাক্তার এল জেমেনহফ এই ভাষা তৈরিই করেছিলেন ইংরেজির বিশ্বজোড়া প্রভাব রুখতে। কিন্তু এই ভাষাকে এখন বিশারদরা বিশুদ্ধ কন্ল্যাং বলেন না, বলেন ‘অক্সিলিয়ারি’ ভাষা। তার কারণ বোধ হয়: রোমান্স আর জার্মানিক ভাষা থেকে নেওয়া এর শব্দভাণ্ডার, ব্যাকরণ ধার করা স্লাভিক ভাষাগুলো থেকে। একদম আগেকার যুগকে ছাড় দিয়ে, পুরোপুরি নতুন ভাষাকেই শুধু কনল্যাং-এর সম্মান দেওয়া হয়। তাতে অবশ্য কিচ্ছু এসে যায় না, এসপেরান্টোর প্রচার ও প্রভাব এক সময় ছিল বিপুল। এই ভাষার আছে নিজস্ব বর্ণমালা তো বটেই, এমনকী পরিচয়বাহী ফ্ল্যাগ, কার্যনির্বাহী অ্যাকাডেমি, সবচেয়ে বড় কথা, সর্বাধিক ১০০০ লোকের ‘নেটিভ ভাষা’-র গৌরবমুকুট। তবে এসপেরান্টোর থেকেও বেশি সংখ্যায় লোকে কথা এক দিন কথা বলত ‘ভলাপুক’ নামের ভাষায়। বানিয়েছিলেন উনিশ শতকের এক জার্মান ক্যাথলিক পাদ্রি জোহান মার্টিন স্লেইয়ার। গোটা পৃথিবীতে অন্তত ১৮০টা ক্লাব ছিল যে ভাষার, সে-ই এক দিন হারিয়ে গেল নীরবে, কারণ স্লেইয়ার উদ্ধত হিটলারি ঘোষণা করলেন: তাঁর ভাষায় নতুন নতুন শব্দ তৈরির একচেটিয়া অধিকার শুধু তাঁরই, আর কেউ এ কাজ করতে পারবে না!
১৯৪৯ সালে চার্লস ব্লিস নামের এক কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার সাংহাইতে বসে দীর্ঘ আট বছরের শ্রমে তৈরি করেন ‘ব্লিসিম্বলিকস’। পিকটোগ্রাফিক এই ভাষায় ছিল শ’য়ে শ’য়ে প্রতীক যেগুলো আদতে এক একটা ধারণার (concept) পরিচায়ক, আবার এক গুচ্ছ প্রতীককে সাজিয়ে গুছিয়ে বানানো যেত আনকোরা নতুন আর একটা প্রতীক, অর্থাত্‌ ধারণা। এই ভদ্রলোক বেমক্কা খেপে উঠলেন, যখন কিছু শিক্ষক এই ভাষাটাকে নিজেরাই টুকটাক বদলে নিয়ে সেরিব্রাল পল্সি-আক্রান্ত শিশুদের ইংরেজি শেখানোর কাজে লাগালেন।
জোনাথন টেগায়ার বানিয়েছেন ‘ইও’ (Aeo, অর্থ ‘বলা’), যাতে কোনও ব্যঞ্জন ধ্বনি/বর্ণ তো নেইই, স্বরধ্বনিও মোটে তিনটে। সিলভিয়া সোতোমেয়র-এর বানানো ভাষা ‘কেলেন’, যাতে ক্রিয়াপদ বলে কিচ্ছু নেই, স্ক্রিপ্ট অদ্ভুত ভাবে দেবনাগরী-সদৃশ! ২০০১-এ সোনিয়া এলেন কিসা তৈরি করেন ‘টকি পনা’, যার লক্ষ্য: জোর করে ছোট্ট, সীমিত অথচ জমাটি একটা ভাষা তৈরি করা। এ ভাষায় আছে মাত্র ১৪টি ধ্বনি আর ১২৩টি শব্দমূল (root word)। কিসা খুব খুশি, কারণ তাঁর ভাষায় গোটা পৃথিবীতে তিন জন মানুষ (তিনি বাদে) দিব্যি কথা বলতে পারেন, নেটে চলনসই চ্যাট করতে পারেন আরও কিছু সংখ্যক। নব্বই দশকের শেষে আমেরিকার জিম হেনরি অনেক খেটেখুটে বানিয়েছেন ‘জা-জিম-বিন’। শুরুর প্রথম দু’বছর মাথা ঘামিয়েছেন স্রেফ ধ্বনির কাঠামোটা বানাতে, তার পরও এক বছর ব্যাকরণ নিয়ে চুলচেরা কাটাছেঁড়ায়। এত সব কিছুর পর আজ এই ভাষায় কথা বলেন কে? স্রেফ তিনি নিজে।
জিম বলেছেন, এক একটা দিন আসে, যে দিন হয়তো বা আমার ভাষাটায় কিছু পড়া বা লেখা হয়ে ওঠে না। কিন্তু এমন একটা দিন নেই, যে দিন আমার নিজের গড়া ভাষায় ভাবি না, বা প্রার্থনা করি না, বা নিজের সঙ্গে কথা বলি না। আমার ভাষাটা তো তাতে মিথ্যে হয়ে গেল না!

ছবি: সুমন চৌধুরী


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.