শিল্প যখন ঠোঁটকাটা থাপ্পড়বান
আজকের হিরো: ফিউচারিজম
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখনও পাঁচ বছর দূরে, সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ‘ইন্টারপ্রিটেশন অফ ড্রিমস’ অর্ধেক লোক জানে না, কারণ ইংরেজি অনুবাদ হয়নি, পাবলো পিকাসো প্যারিসে ছবি আঁকা-য় আর জেমস জয়েস ট্রিয়েস্টে শহরে গল্প লেখায় হাত মকশো করছেন, দুনিয়ার ভোল পালটে দেওয়া রুশ বিপ্লবও দূর অস্ত। সেই বিংশ শতকের গোড়ায়, ১৯০৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির বোলোনা শহরের খবরের কাগজ ‘লা গ্যাজেটা দেল এমিলিয়া’র পাতায় বোমা ফাটল। হপ্তা দুয়েক যেতে না যেতেই আবার, এ বারে ফরাসি দৈনিক ‘লে ফিগারো’তে। এমন রাগে গরগর লেখনী, অপূর্ব কাব্যিক ভাষা, একেবারে অন্য রকম উপমা-প্রতীক, আর সোজাসাপটা ডোন্ট কেয়ার ভাবের মিশেল কার? একটু এগোতেই এগারোখানা সৃষ্টিছাড়া পয়েন্ট, পড়লেই তুলকালাম, আর খুঁটিনাটি ভাবলে, জীবনে বা শিল্পে কাজে লাগালে তো না জানি কী! ইতালিয়ান কবি-চিন্তাবিদ ফিলিপ্পো টোমাসো ম্যারিনেত্তি-র হাত ধরে যাত্রা শুরু ‘ফিউচারিজম’-এর, আনকোরা নতুন, বে-পথগামী, বৈপ্লবিক এক শিল্প ও জীবন-দর্শনের, যার এগারো-পয়েন্টের ম্যানিফেস্টো বিংশ শতকের প্রথমার্ধ জুড়ে তোলপাড় করবে গোটা দুনিয়াকে, অদূর ভবিষ্যতে জন্ম দেবে সাহিত্য-চিত্রকলা-সঙ্গীত-দর্শনের অগুনতি প্রতিষ্ঠান-বিরোধী, আধুনিক মতবাদের, আন্দোলনের।
যুগটা ছিল যন্ত্রের। গ্রাম-জীবন ছেড়ে মানুষ আসছে শহরে, বাঁচছে নাগরিক যান্ত্রিকতায়। পুরনো, মন্থর, ঐতিহ্যময় যা কিছু, সব ছেড়েছুড়ে জীবন ছুটছে যেন পায়ের তলায় সরষে, কানের পাশে চরৈবেতি জপছে চাকা, মেশিনের ঘরঘর, টেকনোলজির উদ্ভাস। শুধু গতি, চিত্‌কার। ‘আমরা ঘোষণা করছি, পৃথিবীর জাঁকজমক আরও এক ঘাট বেড়েছে নতুন এক সৌন্দর্যে— গতির সৌন্দর্য। ইতিহাস-প্রাচীন মর্মর স্থাপত্য-কীর্তি ‘ভিকট্রি’র চেয়ে, রেসিং কারের বনেট-ভর্তি সাপের মতো কিলবিল বিস্ফোরক-শ্বাসওলা টিউব, মেশিনগানের আগুনে গুলির মতো গজরানো মোটর গাড়ির বাহার আমাদের চোখ জুড়োয় অনেক বেশি।’ ফিউচারিস্টরা এ ভাবেই আঁকড়ে ধরেছেন যান্ত্রিক সমসময়কে, মাথায় তুলে নেচেছেন চূড়ান্ত আগ্রাসী, প্রতিক্রিয়াশীল যা কিছুকেই। তাঁদের সটান বক্তব্য, যুদ্ধ একটা অত্যন্ত দরকারি জিনিস, একটা শোধন-প্রক্রিয়া, যার মধ্য দিয়ে পরিপুষ্ট হয় ‘হিউম্যান স্পিরিট’, ত্বরান্বিত হয় আদর্শবাদ। এ হেন উল্টো-ধারা বিশ্বাস ও চিন্তা-ভাবনা, বলাই বাহুল্য, তখনকার পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্ম প্রতিষ্ঠান-নির্বিশেষে ফিউচারিজ্মকে দিয়েছিল অলক্ষুণে, সর্বনেশে তকমা।
উমবের্তো বোচ্চিওনির ছবি ‘দ্য সিটি রাইজেস’

ফিউচারিজমের ম্যানিফেস্টোর সুবিখ্যাত (এবং নিন্দিত) এগারো দফা ছিল এ রকম:
. আমরা জয়গান গাই বিপদের, ভালবাসি উদ্ধত প্রাণশক্তি আর দুর্বিনয়কে।
. আমাদের কবিতার অবিসংবাদিত উপাদান হবে সাহস, স্পর্ধা আর বিদ্রোহ।
. এতদিনকার সাহিত্য শুধু এক বিষণ্ণ কর্মহীনতায়, তুরীয় আনন্দে বা ঘুমে ডুবে ছিল। আমরা সেখানে আনতে চাই আগ্রাসী উদ্যম, জ্বর-জাগা অনিদ্রা, দৌড়বাজের লাফ, মরণ-ঝাঁপ, ঘুসি, থাপ্পড়।
. পৃথিবী সম্প্রতি সুন্দরতর হয়েছে অনিবার্য গতির জোরে। জীবনে এই গতি, দ্রুতির সংযোগই একটা আধুনিকতম যানকে করে তুলেছে যে কোনও ধ্রুপদী কলা-কীর্তির থেকে অনেক বেশি আকর্ষণীয়।
. চাকার পেছনে থাকা মানুষটিই আমাদের আরাধ্য, কারণ তাঁর প্রাণশক্তির রাশটা ছড়িয়ে, জড়িয়ে আছে বিশ্বের ও-পার অবধি।
. কবির (শিল্পীর) কাজই হল আবেগের তীব্রতায়, উত্‌কর্ষে ও ঔদার্যে নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দেওয়া, সৃষ্টির শুরুর জীবন-বেগকে প্রবল থেকে প্রবলতর করে তোলা।
. সুন্দরের বাস শুধু সংঘাতের মধ্যেই। যে শিল্পকর্ম আগ্রাসী নয়, তা কখনওই ‘মাস্টারপিস’ হতে পারে না। কবিতার কাজই হবে অজানা যত শক্তিকে হিংস্র আঘাত হেনে তাদের মানুষের সামনে মাথা নোয়াতে বাধ্য করা।
. শত শতাব্দীর প্রান্তভূমিতে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। আর পেছনে ফিরে চাইব না, অসম্ভবের যত রহস্যময় দরজাগুলো ভাঙাই এখন সামনের কাজ। স্থান-কালের মৃত্যু হয়েছে গতকালই, আমরা এখন আছি অসীম, চরমের (Absolute) মধ্যে, কেননা আমরা তো এরই মধ্যে অনন্ত, সর্বব্যাপী গতি আয়ত্ত করে ফেলেছি।
. যুদ্ধ এই পৃথিবীর একমাত্র দাওয়াই। আমরা সমর্থন করি যুদ্ধ, সামরিক অভিযান, উগ্র দেশপ্রেম, অরাজকতা, নারী-বিদ্বেষ, যা কিছুর জন্য মরা যায় তাকেই।
১০. আমরা গুঁড়িয়ে দেব সব মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, অ্যাকাডেমি, আর লড়ব নারীবাদ, নৈতিকতা ও যত রকমের সুযোগ-সন্ধানী বা উপযোগবাদী (utilitarian) কাপুরুষতার বিরুদ্ধে।
১১. কাজ-পাগল, আনন্দ-প্রেমী আর দাঙ্গাবাজ জনতা আমাদের উপাস্য। আধুনিক রাজধানীগুলো আমরা প্লাবিত করতে চাই বর্ণিল, বহুস্বর বিপ্লবের ঢেউয়ে। আমরা গান গাই রাতের অস্ত্রাগারের, আলোকিত কারখানার, হাঁ-মুখ রেল স্টেশনের, দানবীয় ব্রিজের, অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় স্টিমারের, উড়ন্ত বিমানের। এ দেশ, দুনিয়া মুক্ত হোক পচা দুর্গন্ধ গ্যাংগ্রিনওলা প্রফেসর, প্রত্নতাত্ত্বিক আর অতীত-বিশারদদের কবল থেকে।
ম্যারিনেত্তির এই ম্যানিফেস্টো নিমেষে জয় করেছিল উমবের্তো বোচ্চিওনি, জিনো সেভেরনিনি, গিয়াকোমো বাল্লা-র মতো চিত্রশিল্পী, লুইগি রুসোলো-র মতো সংগীতকারের শিল্পীমন। বোচ্চিওনির বিখ্যাত ছবি ‘দ্য সিটি রাইজেস’-এ দেখা যায় যান্ত্রিক নগরসভ্যতার প্রেক্ষাপটে টকটকে রক্তলাল একটা দামাল ঘোড়া, যাকে লাগাম টেনে ধরে রাখতে পারছে না কেউ। দ্রুতি, গতি, তুলকালাম ও ক্ষমাহীন ভাঙচুরের উপাসনা। সহজেই বোঝা যায়, অতীত, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ— যা কিছুই যুগ যুগ ধরে মানুষের রক্তে বহতা, তারই শেকড় ধরে টান দিয়েছিল এই ম্যানিফেস্টো। আবার অচিরেই ইন্ধন জুগিয়েছিল ইতালির রাজনীতিতে মাথা-চাড়া দেওয়া ফ্যাসিজমের আগুনেও। ‘কমব্যাটো ফ্যাসিস্তি’ ক্ষমতায় আসার পর তার অংশও হয়েছিল ফিউচারিজম, ম্যারিনেত্তি নিজে ছিলেন ফ্যাসিস্ত রাজনীতির সক্রিয় কর্মী। ফিউচারিজ্মের জীবন-বোধ বহু ক্ষেত্রেই মানবিকতা-বিরোধী ও প্রখর দমন-নীতিবাদী হলেও সে কালের অতি-রক্ষণশীলতার দুর্গে যে মোক্ষম ফাটল ধরিয়েছিল, মানতেই হবে। ঐতিহাসিক স্থাপত্যে-ভাস্কর্যে মোড়া রোমের অপরূপ গির্জা বা মিউজিয়ামগুলোকে ম্যারিনেত্তি বলেছিলেন কবরস্থান, নিত্য সেখানে লক্ষ পর্যটকের আনাগোনাকে বলেছিলেন ভণ্ডামি, আদিখ্যেতা। মানুষের অন্তহীন অতীত-বন্দনার গোড়ায় কুড়ুল মেরেছিলেন, চেয়েছিলেন লাইব্রেরির যাবতীয় বই পুড়িয়ে দিতে, দু’হাতে নদীর গতি বদল করে তার জলে শহরের মিউজিয়ামগুলোকে ডুবিয়ে দিতে, হাতুড়ি-কুড়ুলের ঘায়ে যত তীর্থ, মহানগর খানখান করতে। শিল্পে যে উগ্রতা, হিংস্রতা, তা সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। ধ্বংসেই মুক্তি, বিনাশেই সৃষ্টি নব নব। ‘Erect on the summit of the world, once again we hurl defiance to the stars!’



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.