নোটখানা হাতে নিয়ে সনাতনদাদু বলেন, ‘এত টাকা পেলে কোথায় তুমি?’
‘রোজগার করলুম’, হেসে জবাব দেয় ক্লাস সিক্সের টিপু।
এই মুখ টিপে রহস্যময় হাসি হাসা টিপুর এক স্টাইল। বাইরে বলার মতো কোনও ঘটনা ঘটলে বাড়ি ফিরে ওই রকম হেসে মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আজকের বড় খবর কী বলো তো মা?’
খেলার মাঠ থেকে ফিরেছে টিপু, হাত দু’টি পিছনে। কপালে চুলের গোছা।
‘তুই দৌড়ে ফার্স্ট হয়েছিস।’
টিপু অবাক! মা কেমন করে জানল? ‘জয় ফোন করেছিল?’ জানতে চায় সে।
‘জয় না’, মা কাছে এসে টিপুর পিছনে লুকিয়ে রাখা কাপটা হাতে নেন। বলেন, ‘তোর স্পোর্টস টিচার।’
এখন সনাতনদাদু যখন জিজ্ঞেস করেন, ‘পাঁচশো টাকা তুমি রোজগার করলে কী করে?’ তখন মুখে হাসি টিপু জবাব দেয়, ‘চুপ করে বসে থেকে।’
সনাতনদাদুর জন্যে অনেক কিছু করতে চায় টিপু। টিপু এবং তার বয়সী দীপু, রাণু ও গোলাপিরা। তাদের সরোবর হাউজিং-এ এই এক জনই দুখী মানুষ। এখানে আর সব ভাল— পাম গাছের সারি, চ্যাটার্জি, রাও, দত্তকাকুদের মতো খোশমেজাজি মানুষ আর ওই নীল জলের সুইমিং পুল। ব্যতিক্রম কেবল সনাতনদাদু, অমন ভাঙাচোরা মানুষ এই কমপ্লেক্সে আর এক জনও নেই।
সত্তর পেরিয়ে সনাতন দত্ত সংসারে একা। ছেলে থেকেও নেই। সে বুড়ো বাপের সঙ্গে সম্পর্ক তুলে দিয়েছে। এক ভাগ্নে আর দুই ভাইপো নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। ফোন করে বা চিঠি লিখেও খোঁজ নেয় না, বুড়ো মানুষটা আছে না নেই।
তাই বুঝি সনাতনবাবুর সব বয়স্ক মানুষদের ওপর রাগ। হাজার অসুবিধে হলেও তিনি চ্যাটার্জি বা রাও সাহেবদের কাছে তাঁর সমস্যার কথা বলবেন না, নেবেন না তাঁদের সাহায্য।
তাঁর বন্ধু এখন এই টিপুরা। এককালে ‘শিশুসাথী’তে গল্প লিখতেন দাদু। এখন আর লেখার ক্ষমতা নেই, কিন্তু মুখে বলে আসর মাত করতে পারেন খুব। টিপু এই ছোটদের দলটির লিডার। লেখাপড়ায় চলনসই, কিন্তু স্পোর্টসে নাম্বার ওয়ান। সেই টিপুকেই সনাতন বলেছিলেন পাঁচশো টাকার খুব দরকার তাঁর। হোম ডেলিভারির কানাইয়ের কাছে বাকি আছে। আজকালের মধ্যে দিতে না পারলে খাবার বন্ধ করে দেবে বলেছে।
সুইমিং পুলের ধারে বিকেলে গালে হাত দিয়ে বসেছিল টিপু। পিছনে মাধবীলতার ঝোপ সামনে নীল জলের ঢেউ। সনাতনদাদুকে কী ভাবে সাহায্য করা যায়, ভাবছিল বসে বসে। মা-র কাছে চাইলে পাওয়া যায় টাকাটা, কিন্তু মা তো অ্যাডাল্ট। দাদু নেবে না।
|
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য |
বসে থাকতে থাকতে প্রায় অন্ধকার হয়ে আসে। টিপু উঠতে যাবে, এমন সময় কে যেন বলে ওঠে, ‘আর একটুখানি ভাই, জাস্ট দু’মিনিট বোসো প্লিজ।’
টিকালো নাক। মাথায় বড় বড় চুল, হাতে স্কেচ-বুক সুদাম চৌধুরির বয়স হবে তেইশ-চব্বিশ। ঝোপের আড়াল থেকে হাসি মুখে বেরিয়ে এসে বলে, ‘ভারী সুন্দর ভঙ্গিতে বসেছিলে তুমি, তাই স্কেচ করার লোভ সামলাতে পারিনি। কম্পিটিশনে লাইফ-স্টাডি জমা দেওয়ার আজ শেষ দিন। প্রাইজ পাব কি না জানি না, কিন্তু তোমার ওই বসে থাকার ভঙ্গিটা দারুণ। এটা রাখো।’ টাকাটা প্রায় জোর করে গুঁজে দিলেন টিপুর হাতে, ‘উঁহু, না বললে শুনব না। তোমার দৌলতে যে কাজটা হল এটা আমার বড় লাভ। থ্যাঙ্ক ইউ, এই নাও আমার কার্ড।’
টিপু তো খুবই অবাক হয়েছিল পাঁচশো টাকা পেয়ে। সনাতনদাদুকে সেটা দিতে তাঁর তো বাক্যি হারিয়ে যাওয়ার জোগাড়। তার পর টিপু যখন বলে কী ভাবে রোজগার করেছে সে টাকাটা, তখন তাঁর আনন্দ দেখে কে।
তখনই কানাইদার নম্বর ডায়াল করে বলা হয়, সে যদি তার পাওনা টাকাটা নিয়ে যায়, তবে বড় ভল হয়। কানাই বলে রাতে ও যখন দাদুর খাবার নিয়ে আসবে তখনই নিয়ে নেবে তার প্রাপ্য। আজ রাতের মেনু কী, তা-ও জানিয়ে দেয়— আলুর পরোটা আর মেটেচচ্চড়ি রেঁধেছেন তাঁর মা।
বাড়ি ফিরতে সে দিন একটু দেরিই হয় টিপুর। মা দরজা খুলতে সে জিজ্ঞেস করতে যাবে, ‘বলো তো আজকের সেরা খবর কী?’ তার আগেই মা বলেন, ‘ভাল করেছ খোকন। এইমাত্র সনাতনবাবু ফোন করেছিলেন। আর্ট কলেজের এক ছাত্র তোমাকে জলের ধারে বসে থাকতে দেখে তোমার স্কেচ এঁকে ওই টাকা দিয়েছেন—
মাথা নেড়ে টিপু বলে, ‘হ্যাঁ।’ ‘ভাল’, মা টিপুর কাছে এসে বলেন, ‘তোমার প্রথম রোজগার এক জন দুঃস্থ মানুষের কাজে লাগল, এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে?’
মা এখন টিপুর খুব কাছে। একটা হাতে টিপুর কপালে এসে পড়া চুলগুলো ওপরে তুলে দিচ্ছেন আর একটা হাত রেখেছেন তার কাঁধে।
টিপু মুখ টিপে হেসে তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আজকের সেরা খবর কী বলো তো?’ ‘কী? তোমার প্রথম কিছু রোজগার করা...’ ‘না’, হাসি মুখেই মাথা নাড়ে টিপু। ‘তবে কি কারও জন্য কিছু করতে পারা...?’
এখনও টিপু মাথা নাড়ে। মাকে বলে না টিপু, কিন্তু সে ভাল ভাবেই জানে আজকের সেরা খবর এই যে, মা তার কাছে এসে তার মাথায় হাত রেখেছে এটাই।
এখন সুদাম আঙ্কল থাকলে বেশ হত। টিপু বলত, ‘কাকু, আপনি অনেকক্ষণ সময় নিয়ে আঁকুন এই ছবিটা। আর এর জন্যে শুধু ছবিটাই দেবেন আমায়, বুঝলেন তো, আর কিচ্ছু না। |