প্রবন্ধ...
‘চল্, খেতে দেব’
তিনটি বোনের কাহিনি এখন অনেকেরই জানা। তাদের বাড়ি ছিল, হিন্দি বলয়ের চিঠিপত্রের বয়ান অনুযায়ী, গ্রাম: মারমাডি, তহশিল: লখনি, জেলা: গোন্ডিয়া। মহারাষ্ট্র। তিন বোন: ৬, ৯ আর ১১। এক দিন ইস্কুলে যাওয়ার পরে তারা আর বাড়ি ফিরল না। সেটা ১৪ ফেব্রুয়ারি। তাদের বন্ধুরা তাদের দু’টি ইস্কুলব্যাগ বাড়িতে এনে দিয়েছিল। তাদের বিধবা মা, শ্রমিক মা, থানায় গেলেন, গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরলেন, কিন্তু মেয়েদের আর পেলেন না। পুলিশ প্রথমে তাঁকে বড় একটা গুরুত্ব দিল না। প্রান্তবাসীরা যেমন ব্যবহার পেতে পেতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন, সেই মা-ও তেমনই ব্যবহার পেলেন পুলিশ-প্রশাসনের কাছ থেকে। প্রথম দিকে রাজনীতিকেরাও বড় একটা পাত্তা দিলেন না। মিডিয়াও। কিন্তু তিনি দমলেন না। স্বামীকে চার বছর আগে হারিয়ে যে নারীকে দিনমজুরের কাজ করে তিন মেয়ের আর নিজের গ্রাসাচ্ছাদন করতে হয়, তাঁর কি আর এত সহজে দমলে চলে!
গ্রামের মানুষ তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন। জাতীয় সড়ক অবরোধ করে দাবি জানালেন: তিন কন্যার সন্ধান চাই। ধীরে ধীরে শোরগোল চড়ল। অগত্যা পুলিশ এল, প্রশাসন এল, এলেন রাজনীতিকরা, মিডিয়াও। কয়েক দিন পরে সন্ধান মিলল তিন বোনের। গ্রামের কাছে পরিত্যক্ত কুয়োর অতলে। ময়না তদন্তে জানা গেল, ৬, ৯ আর ১১’র তিন জনকে ধর্ষণের পর খুন করে কুয়োয় ফেলে দেওয়া হয়েছে।
চতুর্দিকে আওয়াজ উঠল, দোষীদের শাস্তি চাই। পুলিশের বড়কর্তারা শিবির করে বসে রইলেন গ্রামে। সরকার বলল, ক্ষতিপূরণ দেব। ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে বিচার চলবে। দোষীদের সন্ধান দিতে পারলে ইনাম মিলবে ৫০ হাজার টাকা! প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। এখনও পর্যন্ত অবশ্য গ্রেফতার হয়নি কেউ।
শিল্পী: সুমন চৌধুরী
আসলে, ভান্ডারা তো আর দিল্লি নয় যে, সরকার, রাজনীতিক, মিডিয়া আর সব কিছু ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়বেন! আর আমরা? নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা? দিল্লিতে যন্তর-মন্তরে ঘাঁটি গেড়ে মোমবাতি মিছিল করলেও ভান্ডারার এক প্রান্তবাসী পরিবারের জন্য সেই উদ্যোগে ভাটা পড়ে। এটাই তো আসল ‘আমরা-ওরা’!
তবু ধন্য আশা কুহকিনী তদন্ত চলছে, শিশু তিনটির খুনের কারণ ঠিক কী, সেটা নিশ্চিত জানার জন্য সেই তদন্ত শেষ হওয়ার অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই। কিন্তু ইতিমধ্যে জানা গিয়েছে যে, ওই তিন বোনকে নাকি খাবারের লোভ দেখিয়ে ইস্কুল থেকে নিয়ে গিয়েছিল অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীরা। অনতিদূরের নিয়তির কথা জানতেও পারেনি সেই ৬, ৯ আর ১১। খাবারের লোভ দেখিয়ে তিনটি শিশুকন্যাকে এ ভাবে নিয়ে যাওয়া যায়! যেতেই পারে। তাদের তো আর দু’বেলা খাবার জোটে না ঠিকঠাক। দিনমজুর মা আর কতই বা রোজগার করতে পারেন? তাই ‘চল্, খেতে দেব’ বলে তাদের নিয়ে যাওয়া খুব কঠিন হবে কেন? দুমুঠো খাবারের অভাব আর একেবারে প্রাথমিক নিরাপত্তার অভাব এ ভাবেই কেমন একাকার হয়ে যায় না? অমর্ত্য সেন বলেছেন, দারিদ্রের একটা বড় রূপ হল, খাদ্যাভাব, ক্ষুধার্ত থাকা। সর্বগ্রাসী সেই ক্ষুধার টানই হয়তো তিন বোনকে নিরাপত্তার কথা ভাবতে শেখায়নি, চিনতে শেখায়নি নাগরিক হায়েনাদেরও!
এই ভাবে ভাবলে হয়তো ‘সামাজিক নিরাপত্তা’ কথাটায় একটা নতুন মাত্রা যোগ হয়। কিংবা, ভারতের আদালত কেন খাদ্যের অধিকারকে ‘জীবনের অধিকার’-এর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে গণ্য করেছেন, তারও একটা আক্ষরিক অর্থেই মর্মান্তিক প্রমাণ পাওয়া যায়। আমাদের শহুরে চিন্তায় আর পোশাকি আলোচনায় যে প্রমাণ চোখে পড়ে না, যে মাত্রা খুঁজে পাই না। প্রান্তিক মানুষের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে, তাঁদের জীবনটাকে মন দিয়ে দেখার চেষ্টা করলে হয়তো সেই না-বোঝা সত্যগুলো একটু একটু বুঝতে পারি, যেমন ‘খাদ্য নিরাপত্তা’ কথাটার সামান্য আঁচ পাই।
মনে পড়ল এক বৃদ্ধ দম্পতির কথা। ডুয়ার্সের ভার্নাবাড়ি চা বাগানে খালাসির কাজ করতেন সুকু ভক্তা। ২০০৭-এর মার্চে সুকু ও তাঁর স্ত্রী মুন্নির সঙ্গে যখন দেখা হয়েছিল, তখন সে বাগান বন্ধ। তত দিনে সেই বাগানে অনাহারে-অর্ধাহারে, রোগে ভুগে ৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। দু’পায়ের প্রবল ব্যথায় সুকু আর হাঁটতে পারেন না। সন্ধ্যার মুখে বাগানের জরাজীর্ণ ঘরে মিশকালো রান্নাঘরে কাঠ জ্বেলে চা বানাচ্ছিলেন মুন্নি। প্রবল ঠান্ডায় পরনে ছেঁড়া সোয়েটার, মাথায় সবুজ ওড়না। বড় ছেলে মানসিক ভারসাম্যহীন। ছোটটি কাজের সন্ধানে বছরখানেক আগে দিল্লি গিয়ে এক বারই এক হাজার টাকা পাঠিয়েছিল মা-বাবার জন্য। ঘরে কুপি জ্বালানোর তেল নেই। সকালে এক বারই ভাত জুটেছে। সন্ধে-সন্ধে চা কেন? আর কিছু নেই? শহুরে অজ্ঞতায় বোধহয় করুণা হয়েছিল সেই দম্পতির। বলেছিলেন, ‘জানো না, চা খেলে খিদে মরে? চা খেয়েই শুয়ে পড়ব।’
অতল নাগরিক উদাসীনতায় আর কখনও সেই দম্পতির খোঁজও নিতে যাইনি। বাগান এখন টিমটিম করে চললেও জানি না, তাঁরা এখন কোথায়, কী অবস্থায় আছেন?
এই কয়েক দিন আগে, ডুয়ার্সেরই বীরপাড়া চা বাগানে আলাপ হল এক প্রাথমিক শিক্ষকের সঙ্গে। বাংলা মাধ্যমের সেই ইস্কুলে সে দিন পড়ুয়ার সংখ্যা ৪২। আর নেই কেউ? ‘আছে তো আরও অনেকে। কিন্তু আজ শ্রমিক বস্তিতে বিয়েবাড়ি, ওরা অনেকে সেখানে খেতে গেছে। সব দিন তো ভূরিভোজ হয় না।’ বলছিলেন সেই শিক্ষক।
সে দিন মিড ডে মিলের মেনু খিচুড়ি আর আচার। ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ডে বাংলা অক্ষরে তা লেখাও রয়েছে। ঘণ্টা বাজে খাওয়ার। যার যার থালা নিয়ে ইস্কুলের মাঠেই লাইন দিয়ে বসে পড়ে উল্লসিত পড়ুয়ারা। এক-এক হাতা খিচুড়ি, সঙ্গে ছোট চামচের আচার। শুরু হয় চেটেপুটে খাওয়া। মায়াভরা চোখে সে দিকে তাকিয়ে ওই শিক্ষক বলতে থাকেন, ‘কী-ই বা দিতে পারি ওদের? মাথাপিছু ৩ টাকা ৩৩ পয়সা বরাদ্দ। এতে কী হয় বলুন? ইস্কুলে এলে তবু তো দুপুরের একটু খাওয়া হয়। কারা ওদের কথা ভাববে?’
ক্ষুধাই মিলিয়ে দেয় ভান্ডারা ও ডুয়ার্সকে!
সংসদে আর কয়েক দিনের মধ্যেই পেশ হতে পারে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা বিল। আলোচনাও হবে তা নিয়ে। গর্জন-পাল্টা গর্জনে উত্তপ্ত হয়ে উঠবে সংসদ-কক্ষ। এই বিল আইনে পরিণত হলেই যে দেশের দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষজন ঠিকমতো চাল-গম পাবেনই, এমন নিশ্চয়তা অবশ্যই দেওয়া যাবে না। তবু অন্তত একটা উদ্যোগ তো হচ্ছে। আর তাই মনে হয়, খাদ্য নিরাপত্তা বিল নিয়ে তর্কবিতর্কের মুহূর্তগুলোয় কি সংসদে না-থেকেও থাকতে পারবেন এই প্রান্তবাসীরা? তাঁদের অবস্থান থেকে ক্ষুধা আর নিরাপত্তার সম্পর্কটাকে বোঝার একটা চেষ্টা করবেন কি জনপ্রতিনিধিরা? তাঁদের সেই চেষ্টা করতে বাধ্য করব কি আমরা, অহঙ্কারী নাগরিক সমাজ? গণতন্ত্র আর সার্বভৌমত্বের সেই পীঠস্থানে কি কখনও রচিত হবে খাবারের লোভে ঘাতকের সঙ্গে চলে যাওয়া তিন বোনের এপিটাফ?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.