চিনের গুয়াংঝাউ চিড়িয়াখানায় কর্মখালির বিজ্ঞাপনে জানানো হইল, যে কর্মীরা পশুদের খাওয়াইবেন, তাহাদের বর্জ্য পরিদর্শন করিবেন ও খাঁচা পরিষ্কার রাখিবেন, উঁহাদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতাবলির একটি: মার্ক্সবাদের দর্শন ও নীতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান। জানাজানি হইবা মাত্র বহু প্রকার রসিকতা ছড়াইয়াছে। কেহ বলিতেছে, এই কর্মীরা অচিরেই প্রশাসনিক পদে যোগ দিবেন, কারণ এই দেশে মার্ক্সবাদই তো শিখায়, পশুদের উপর প্রভুত্ব কায়েম করিতে হয় কী রূপে। কেহ বলিয়াছে, চিড়িয়াখানা তো উঠিয়া যাইবে, কারণ এই কর্মীরা সর্বহারা জন্তুদের খাঁচা খুলিয়া দিবার দীক্ষাই কি পায় নাই? কেহ জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’ উপন্যাসটি অবলম্বনে রসিকতা গড়িয়াছে: মনে রাখিও কর্মিগণ, সকল পশু সমান, তবে কয়েকটি পশু অন্যদের তুলনায় অধিক সমান। পৃথিবীর ইতিহাসে মার্ক্সবাদ এক অতি গুরুত্বপূর্ণ দর্শন সন্দেহ নাই, কিন্তু এই কর্মগুলির জন্য তাহা কী কারণে জরুরি এক শিক্ষণীয়-বিষয়, কেহই বুঝিতে পারিতেছে না। সাধারণত ঝাঁটা ধরিতে বা ব্যাঘ্রের সম্মুখে মাংসখণ্ড ছুড়িতে দর্শনশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি প্রয়োজন হয় না। হয়তো কর্তাদের মনে হইয়াছে, জীবনের ক্ষুদ্র ও বৃহৎ প্রতিটি পদেই যে দর্শনটির সাহায্য লওয়া উচিত বলিয়া এই রাষ্ট্র মনে করিয়া থাকে, সেটি না জানিয়া সমাজের কোনও ক্ষেত্রেই যোগ্যতা অর্জন অসম্ভব, ইহা বেশ করিয়া বুঝাইয়া দেওয়া আবশ্যক। অথবা, খুব সম্ভবত, বিজ্ঞপ্তি লিখিতে বসিয়া দিনে সহস্র বার মুদ্রাদোষের ন্যায় ব্যবহৃত এই অতিপরিচিত লব্জ হাতে আসিয়া গিয়াছে।
আমাদের রাজ্যের মার্ক্সবাদ লইয়া মহাব্যস্ত এক রাজনৈতিক দলের কথা এই সূত্রে মনে পড়িতে পারে। ক্ষমতায় থাকিবার সময় তাহারা মনে করিত, সমাজের যে কোনও কর্মেই প্রাথমিক যোগ্যতা হইল: তাহাদের দলের প্রতি আনুগত্য। শিক্ষক পড়াশুনা জানেন কি না তাহা পরের প্রশ্ন, প্রথম প্রশ্ন: তিনি কি রাজ্যের বামপন্থী শাসক দলের চরণে মুহুর্মুহু কুর্নিশ করিতে রাজি? সাহিত্যিকের রচনা উতরাইল কি না তাহা অনেক পরে দেখিলেও চলিবে, পূর্বে বিচার্য তিনি শাসক দলের সমীপে দাঁত বাহির করিয়া হাত কচলাইতে উৎসাহী কি না, তবে পুরস্কারের তালিকায় তাঁহার নাম ঢুকিবে। এমনকী প্রবল প্রযুক্তিগত যোগ্যতার প্রয়োজন যে সকল কর্মে, তাহাতেও বিশেষজ্ঞের পরিবর্তে বিশেষ দলদাস নিযুক্ত করিবার প্রতি এই দলের প্রবল প্রয়াস লক্ষিত হইত। এই প্রবণতা রাজ্যটিকে সর্বাঙ্গীণ অপদার্থতা ও নেতিবাচকতা দিয়া আবৃত করিবার মহৎ কর্ম সম্পন্ন করিয়াছিল। দলটি নিশ্চয়ই স্থির করিয়াছিল, সমাজের উন্নতির তুলনায় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দলটির প্রবেশ ও প্রতিষ্ঠাই প্রাথমিক ভাবে অধিক কাম্য। চিনও হয়তো এই মতেই বিশ্বাসী। তাহারা পশু-পরিচর্যাকারী বা মনুষ্য-সেবকের মধ্যে পার্থক্য করে নাই, শিক্ষক বা সম্মার্জনী-বিশারদের মধ্যে পার্থক্য করে নাই, এক অনঘ সাম্যে বিশ্বাস রাখিয়াছে এবং সকলকে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি নিঃশর্ত প্রণতি শিখাইতে মার্ক্সবাদের নামটি ব্যবহার করিয়াছে। এই স্থলে মার্ক্সবাদ বিষয়ে জ্ঞানী হইবার তাৎপর্য সম্ভবত: সেই মার্ক্সবাদ প্রয়োগে এই রাষ্ট্রই যে শ্রেষ্ঠ মতটি পোষণে সম্মত হওয়া। সেই প্রেক্ষিতে, ওই দেশের প্রতিটি কর্মেই যোগ্যতাটি আবশ্যিক। ইহার সহিত সিংহ বা শশকের সম্পর্ক নাই, শ্বাসরোধী নিয়ন্ত্রণ ও মস্তিষ্ক-প্রক্ষালনের রহিয়াছে, যাহা প্রায়ই মার্ক্সের অসামান্য দর্শনকে আশ্রয় করিয়া ইতিহাসে অশুভ ডানা বিস্তার করিয়াছে। |