পরিত্রাতা ও পরিত্রাণের খোঁজে
বিপন্ন ত্রয়ীর কৃতজ্ঞ থাকা উচিত সর্দারের কাছে
লেখার শিরোনামটা খেয়াল করবেন। সর্দার কে? কে আবারঅতি অবশ্যই একশো টেস্টে পা ফেলতে যাওয়া হরভজন সিংহ। বিপন্ন ত্রয়ীর নাম খুঁজে পাওয়ার জন্যও কোথাও কেউ দু’টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে বসে নেই। নামগুলো এতই সহজ।
সচিন তেন্ডুলকর।
বীরেন্দ্র সহবাগ।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি।
সচিন তেন্ডুলকর: হিন্দি ও ইংরেজি রেডিও ভাষ্যকারেরা চেন্নাইয়ের একটা রাস্তাকে জাতীয় জীবনে অমরত্ব দিয়েছেন। তার নাম ওয়ালাজা রোড। চিপকের চিদম্বরম স্টেডিয়ামে খেলা মানেই এক দিকটাকে ভাষ্যকাররা ক্রমাগত বলে যাবেন প্যাভিলিয়ন প্রান্ত। আর এক দিকটা বর্ণনা হবে ওয়ালাজা রোড এন্ড বলে। এ হেন ওয়ালাজা রোডের ঠিক ক্রসিংয়ের দোকানটা এমন ক্যাটকেটে লাল রঙের সাইনবোর্ড লাগিয়েছে, যে কোনও কারও চোখে পড়ে যেতে বাধ্য। দোকানের নাম সচিন স্পোর্টস। ক্রিকেট সরঞ্জামের বড় দোকান। হোলসেল আর রিটেল দু’টোই করে গোটা দক্ষিণ ভারত জুড়ে। চার ধারে বড় বড় সচিনের ছবি। এমনকী তাঁর বোলিং অ্যাকশনেরও। সিডনি মাঠের খুব কাছে ভিক্টর ট্রাম্পারের ক্রিকেট সরঞ্জামের দোকান ছিল। কিন্তু সেটাও কি মাঠের এত কাছে? সচিন কি এখানেও রেকর্ড করে রাখলেন নাকি? বিষ্যুদবার দোকানটায় ঢুঁ মারতে গিয়ে জানা গেল এটা আদৌ সচিনের দোকান নয়। তাঁর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। মালিক নাকি অন্ধ সচিন ভক্ত। প্রতি বার সচিন চিপকে খেলতে এলে দোকান মালিক যেমন অনিবার্য তিরুপতিতে পুজো চড়ান, এ বারেও তার কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। এমনিতে পশ্চিম বান্দ্রার পেরি ক্রস রোডের বিখ্যাত বাড়িটায় যদি তাঁর দু’টো পয়া মাঠের ছবি টাঙাতে হয় একটা হবে সিডনি। আর একটা হওয়া উচিত চেন্নাই। যেখানে ৯ ম্যাচে তাঁর ৫ টেস্ট সেঞ্চুরি। গড় ৮৭।
এই গ্রহে একজন মনুষ্যও যদি জানে পুজো চড়ানো আর পুরনো রেকর্ড ভাঙিয়ে এক বলের খেলায় পার পাওয়া সম্ভব নয়, তার নাম তেন্ডুলকর! আশেপাশের লোকজন যতই মাত্র দু’মাস আগের দুঃসহ পরিস্থিতি বিস্মৃত হোক, তিনি সচিন তো আর ভুলে যাননি। খুব ভাল জানেন এই সিরিজে রান না পেলে শেষ বাঁশি বেজে গেল। এরাপল্লি প্রসন্ন আজকেও যা বলছিলেন সেটা দ্রুত ফের ক্রিকেট বিশ্বের কোরাস হয়ে যাবে, “এ বার ছেড়ে দিক না।” সমীর দিঘে জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া মরাঠির ঘনিষ্ঠতম বৃত্তে পড়েন। প্রাক্তন ভারতীয় কিপার দিঘের আর একটা ছোট পরিচয়, এই চেন্নাইয়ের মাঠে অস্ট্রেলীয়দের বিরুদ্ধে অপরাজিত ২২ রানের এমন ইনিংস খেলেছিলেন যা পরিস্থিতি মাহাত্ম্যে ধরা হয় ২২০। সিরিজের অন্তিমে সেই ইনিংসটা খেলা না হলে সৌরভের স্টিভ-জয় অসম্ভব ছিল। মুম্বইয়ে রাতে ফোনে ধরলে দিঘে অবশ্য ২-১ সিরিজ জিতিয়ে দেওয়া তাঁর চূড়ান্ত প্রয়াস নয়। বন্ধুর নতুন মহাযুদ্ধ নিয়ে আলোচনাতেই উৎসাহ দেখালেন। “সচিন চার্জড হয়ে আছে। এই সিরিজে তো রান পেয়ে পুরোটা খেলবেই। আমার ধারণা, বছরের শেষে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেও যাবে।”
মহানাটিকার পাত্রকে দেখে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই কোনও চাপ আছে বলে। নেটে অনুশীলনও বরাবরের মতোই বিপক্ষ দলভিত্তিক প্রস্তুতির! অস্ট্রেলিয়ায় যেহেতু বাঁ হাতি পেসার আছে, তাই স্থানীয় নেট বোলারদের মধ্যে একজন বাঁ হাতি বোলার রাখা। পিটার সিডল ভেতর-বাইরে দু’দিকে মুভ করান। চেষ্টা হচ্ছিল তেমনই ডেলিভারির জন্য ডান হাতির বিরুদ্ধে তৈরি থাকার। রিফ্লেক্স অবশ্যই কমে গিয়েছে। রাহুল দ্রাবিড় তো ঠিকই বলেছেন, “ঘরোয়া ক্রিকেটে সেঞ্চুরি দিয়ে সচিনের ফর্ম আন্দাজ করার মানে হয় না। ওর যা ক্ষমতা পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে একটা স্টাম্প নিয়েও রঞ্জি সেঞ্চুরি করে দেবে।” মিচেল স্টার্ক, জেমস প্যাটিনসন আর পিটার সিডল অবশ্যই অন্য কিছু। তবে গত কয়েক হপ্তা মিডিয়া আর জনতার তাঁকে নিয়ে হাঁকডাক এবং গেল গেল রব যেহেতু অনেক স্তিমিত, প্রায় নিঃশব্দ প্রস্তুতির সুযোগ পেলেন ব্যাটিং চ্যাম্পিয়ন। সিরিজ যত এগোবে হল্লা তত ফেরত আসবে। আগামী শুক্র থেকে মঙ্গলতাই তাঁর সেরা সুযোগ!
বীরেন্দ্র সহবাগ: সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের উত্থানের পিছনে যেমন সদ্যপ্রয়াত চণ্ডী গঙ্গোপাধ্যায় নামক ব্যাকরণ বই। তিনিসহবাগ আপন নিয়মে উৎসারিত এক বিস্ময়। কালো মেঘের মধ্যে আপাতত ক্রিকেট ভবিষ্যৎ তো কী! যে কোনও সময় একটা সহবাগোচিত ইনিংস ঝলমলে সূর্যরশ্মি এনে দিতে পারে চারপাশে। চেন্নাই নাকি কমল হাসনের ‘বিশ্বরূপম’ রিলিজের পর গত মাসখানেকে ভরপুর কোনও বিনোদনের খোঁজ পায়নি। তিনিসহবাগ নিজেকে নিয়ে যাবতীয় সংশয়সূচক কথাবার্তা থামিয়ে দিতে পারেন একটা হঠকে ইনিংসে। তাঁর রান না পাওয়া নিয়ে যারা এত নেগেটিভ, এরা যেন ভুলেই গিয়েছে এ মাঠে তাঁর গড় একশোর ওপর। এমনকী ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আমদবাদ টেস্টের একমাত্র জয়ে সহবাগেরই সেঞ্চুরি ছিল। শুক্রবার ভারত প্রথম ব্যাট করলে অবশ্যই তিনি মাঠে জড়ো থাকা যাবতীয় ক্যামেরার লক্ষ্যবস্তু হবেন। শুনছি চশমা পরে নামবেন। সৌরভের মতো সফট কনট্যাক্ট লেন্স পরে ব্যাটিংয়ের চেষ্টা করছিলেন। চোখে নাকি ধুলো ঢুকে যাচ্ছে। পাওয়ার যে খুব বেশি মোটেও নয়। মাইনাস ০.২৫। অনেক সময় এই পাওয়ারে চোখের ডাক্তাররা সারাক্ষণ চশমা পরার জন্য জোরাজুরি করেন না। কিন্তু সহবাগের খেলাটা যত না টেকনিক তার চেয়ে বেশি ব্যাট-স্পিড আর বলটা দ্রুত দেখা-নির্ভর। ০.২৫ পাওয়ারও সেখানে একটা স্ট্রোকে ছক্কা আর অক্কার তফাত গড়ে দিতে পারে। তাই হয়তো পঙ্কজ রায় আর অংশুমান গায়কোয়াড়ের পর ভারতীয় ক্রিকেট তার তৃতীয় চমশাধারী ওপেনারকে আবিষ্কার করতে যাচ্ছে। সাধারণ ধারণায় চশমা পরে কোনও ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ না খেলে সটান অস্ট্রেলিয়া ঘোর সমস্যা হওয়া উচিত। কিন্তু সহবাগ হলেন সহবাগ। সবাই আর তিনি, এক নয়। দিল্লি ক্রিকেট মহল এখনও বিস্ফারিত ভাবে বীরুর ভাঙা ক্রিকেট ব্যাটের গল্প করে। যে ব্যাট দিয়ে তিনি টানা খেলতেন আর রান করতেন। চশমার সঙ্গে অ্যাডজাস্টমেন্টের প্রাথমিক অস্বস্তিটা তাঁর হবে কি না, ক্রিকেট মহলে কেউ তাই নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। সহবাগ যে ১০৩ নম্বর টেস্টের মুখে দাঁড়িয়েও এক প্রহেলিকা।
যাঁদের নামে ট্রফি। চেন্নাইয়ে সিরিজ শুরুর আগে দুই কিংবদন্তি বর্ডার-গাওস্কর। বৃহস্পতিবার। ছবি: গৌতম ভট্টাচার্য
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি: সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় আনন্দবাজারে গুজবটা তীব্র অস্বীকারের পরেও গোটা বিষ্যুদবার ভারতীয় মিডিয়ার অলিন্দে ফিসফিসানি আর অবিশ্বাস থেকেই গেল। কী, না ভারত অধিনায়ককে ফের তীব্র আক্রমণের মধ্যে ফেলতে পারেন এই ভয়েই সৌরভকে বোর্ড পরিচালিত কমেন্ট্রি প্যানেলে এ বার স্বাগত জানানো হয়নি। যাক গে সে সব কথা। অধিনায়ক ধোনির এই যে গর্দান গেল গেল রবটা উঠেছিল সেটা এখন সম্পূর্ণ অদৃশ্য। হালকা গুঞ্জন যতই এ দিক-ও দিক হোক যে টানা চারটে বড় সিরিজ হেরেও এমন টিকে যাওয়ার ভাগ্য বিশ্বের কোনও অধিনায়কের কখনও হয়নি। চারপাশের সেই ধোনি হটাও রব আর নেই। ভারত অধিনায়ককে দেখাচ্ছেও খুব রিল্যাক্সড। চেন্নাইয়ে তাঁর ক্রিকেট জীবনের পরম আরাধ্য, একই সঙ্গে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরএন শ্রীনিবাসন থাকেন বলেই নয়। এই শহরে তিনি ভীষণ স্বচ্ছন্দ। সাধারণ মানুষ ডাকে ‘এম এস ডি’। কেউ কেউ আদর করে নাম দিয়েছে ‘মারুমাগান’। অর্থাৎ আমাদের জামাই। আদতে জামাই না হয়েও জামাইয়ের ট্রিটমেন্ট পান। রাতের অন্ধকারে একাধিক বার সুপার ফাস্ট বাইক নিয়ে জয় রাইড-এ বেরিয়ে গিয়েছেন ধোনি। এক বার জনতা চিনতে পেরে ভিড় বাঁধিয়ে দিয়েছিল। হুলস্থুল। পুলিশের আগমন। ধোনি পাত্তাই দেননি। চেন্নাই শহরতলির কোথাও তাঁর হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা। আর চেন্নাই পিচ প্রস্তুতকারকের ওপর খবরদারিতেও নেই মানা। মাইকেল ক্লার্ক তো হাসতে হাসতে বলেই দিলেন, “ঘাস যে পরিমাণ ছাঁটা হয়েছে এর পর চাইলেও আর কাটা সম্ভব নয়।” টার্নারে এ বারের অস্ট্রেলিয়াকে ফেলে দিলে তাদের স্বাভাবিক পরিণতি হওয়া উচিতহার। তখন তিনি ধোনি তো নতুন করে বন্দিত হবেন। আর শত্রুর জন্য ফাঁদ পাতা টার্নারে নিজেরা ধরাশায়ী হলেও বিশেষ ভয় এই মুহূর্তে নেই। তাঁর ক্যারিশমায় মোহিত চিপক জনতা বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবে এমন সম্ভাবনা নেই। আর প্রভাবশালী ক্রিকেটলিখিয়ে/প্রাক্তন তারকা ক্রিকেটারদের মধ্যে তো সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে- একে সমালোচনা করেছ কি গেছ!
ভারতীয় মিডিয়া যা-ও বা ক্রিকেট জীবনের বিপজ্জনক বাঁকে দাঁড়ানো ত্রয়ীকে নিয়ে চর্চা করে মাইক্রোস্কোপের তলায় নতুন করে ফেলত। ফের হল্লা বাধিয়ে দিত আম পাবলিকের মনে। এখন তাদের প্রথম নজরে হরভজন সিংহ। রবিচন্দ্রন অশ্বিনের বাবা শুক্রবার চেন্নাইয়ে পুত্রের টেস্ট অভ্যুদয় দেখতে আসছেন ভিআইপি কমপ্লিমেন্টরিতে। একদা ক্রিকেট-পাগল তিনি মাঝরাত্তিরে লাইন দিতেন। কিন্তু চেন্নাইয়ের মননে ঘরের ছেলে অশ্বিনকে ছাপিয়ে প্রথম এখন আক্রমণাত্মক সর্দার। তাই এ দিন শততম টেস্টের সাংবাদিক সম্মেলন করতে এলে তুমুল হাততালিতে তাঁকে স্বাগত জানাল মিডিয়া। ফেরার সময়ও হাততালি। বঞ্চিত এক যোদ্ধা ধ্বংস হয়ে যেতে যেতে হঠাৎ প্রত্যাবর্তন করেছে। শততম টেস্টের পাদানিতে আবার তার পা। এত বড় রোমাঞ্চের পাশে কে সচিন! কে ধোনি! কে সহবাগ!
সে জন্যই তো শিরোনামটা! সর্দারের কাছে যে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত বিপন্ন ত্রয়ীর!




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.