ষাট-সত্তর দশকের বঙ্গজ ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বললে মনে হবে, সদ্য প্রয়াতকে সহানুভূতির যে গ্রেস নম্বর অনিবার্য ভাবে দেওয়া হয়ে থাকে, সেটা দিয়েটিয়েও চণ্ডী গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্রিকেটীয় গরিমা লেখা-যোগ্য অবস্থায় পৌঁছচ্ছে না।
হ্যাঁ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় খেলেছেন সেই মারকাটারি প্রতিদ্বন্দ্বিতার যুগে। এরিয়ানের হয়ে দীর্ঘ দিন ক্লাব ক্রিকেট। ডান হাতি জোরে বোলার। কাঁধের চোটের পর যাঁর গতি বিখ্যাত পুত্রের পর্যায়ে নেমে এসেছিল। স্থানীয় ক্রিকেটাররা একডাকে চিনত শুধু খেলা নয়, মাঠে ও মাঠের বাইরে স্টাইলিশ মনোভাবের জন্য! সেই যুগে প্রথম লোক যিনি খেলতে খেলতে কেরিয়ার সাঙ্গ হওয়া মাত্র ক্রিকেট-প্রশাসক বনে যান। ভীষণ ফ্যাশনদুরস্ত। এক একদিন এক একটা স্যুট পরতেন। কিন্তু ময়দান আরও বেশি মনে রেখেছে কলকাতা মাঠে ক্রিকেটচশমার প্রথম প্রবর্তক হিসেবে। শৌখিন পাওয়ারলেস চশমা পরে ক্রিকেট সম্ভবত সে যুগে কেউ ভাবেইনি।
যেমন এটাও কেউ পরবর্তীকালে ভাবেনি যে বাংলা থেকে এত লড়াকু কেউ একদিন বার হতে পারে যে মুম্বইয়ের সর্বকালের সেরার সঙ্গেও ক্রিকেটমাঠে টক্কর দেবে! বাংলা ক্রমাগত হারতে হারতে যখন হীনমন্যতার অমাবস্যায় চাপা পড়া তখন মৃত সঞ্জীবনী হিসেবে ছোট ছেলের কথা তুলতেন চণ্ডীবাবু। তাঁর বড় ছেলে স্নেহাশিসের ব্যাটিং স্টাইল খুব আকর্ষণীয় বললে সম্মতির ঘাড় নাড়াতেন। তার পর বলতেন, “ছোটটাও তৈরি হচ্ছে দেখো। এ কিন্তু কাঁপাবে।” কাঁপাবে মানে সব নড়িয়ে দেবে। মনের জোরে কারও পিছপা হবে না।
সবাই হাসত অন্ধ পুত্র প্রেম বলে। হাসিটা বদলে যায় ময়দানে সৌরভের আবির্ভাবোত্তর। ক্রিকেটজীবনে এগিয়ে যখন বার বার দুর্বিপাকের মধ্যে পড়ছে সৌরভের ভাগ্যাকাশ পিতার ভরসা কখনও যায়নি। বলেছেন, “বুকটা অন্য রকম ওর। ঠিক বেরিয়ে যাবে। আমি চিনি তো ওকে।” |
বাবার অটল আস্থাটাই ক্রিকেটে যেন শুষে নিয়েছিলেন সৌরভ। তাঁর উত্থানে স্থানীয় ক্রিকেট সংস্থার উল্লেখযোগ্য কোনও ভূমিকাই নেই। পুরোটাই বাবা। দেবু মিত্রকে প্রশিক্ষক ঠিক করে দিয়ে নিয়মিত ইংল্যান্ডে খেলতে পাঠানো। জিম তৈরি রাখা। ছেলেকে ফিজিক্যাল কন্ডিশনিং করতে বলা। বড় বয়সেও খোঁজ নিতে বসা ছেলে সকালে ঠিকঠাক ছুটতে গিয়েছে কি না। চণ্ডী যেন মননে ছিলেন পিতা কাম বিজ্ঞানী। ক্রিকেট মাঠে নিজের জীবন দিয়ে পাওয়া অভিজ্ঞতা থেকে তৈরি করেছিলেন সৌরভকে। পুত্র এবং মানসপুত্র সৌরভ দু’টোই তাঁর একইসঙ্গে!
কাছাকাছি সময়ে তখন দশ-বারো কিলোমিটার দূরের পার্ক সার্কাসের বাড়িতে বসে ভেস পেজ তৈরি করছেন লিয়েন্ডারকে। সৌরভ এবং লিয়েন্ডার বিশ্বে বাঙালি খেলাধুলোর সর্বকালের অন্যতম তেজি বিজ্ঞাপন। যাঁদের আন্তর্জাতিক উড়ান সংক্ষিপ্ত হওয়া অনিবার্য ছিল, এমন আধুনিক অভিভাবকদের সাহায্য ছাড়া। অথচ ভেস এবং চণ্ডীকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে রাজ্যের কোনও ক্রীড়া সংস্থা যে কখনও সম্মানিত করেনি এটা আশ্চর্যের। তার চেয়েও বেশি গভীর লজ্জার।
গঙ্গোপাধ্যায় পরিবারের অবশ্যই আরও মর্মান্তিক লাগবে পুত্রের বিবাহবার্ষিকীর দিন তাঁর বিয়োগে। কিন্তু চণ্ডীবাবু যিনি মাত্র ক’দিন আগে আইসিসিইউ-তে শুয়েও খবর নিয়েছেন, “ইন্ডিয়ার স্কোর কী। কে কত করল,” তাঁর তো কাজ সমাপ্ত। পুত্রের তো আর ক্রিকেট অবশিষ্ট নেই। টেস্ট নেই। ওয়ান ডে নেই। বাংলা নেই। আইপিএল জীবন সেটাও শেষ। এ বার তিনি গবেষণাগারে তালা দিয়ে খুশি মনে ছুটিতে চলে যেতেই পারেন! কাজ তো শেষ! জব ইজ ওভার!
হালফিলের বাঙালি চণ্ডীমণ্ডপ শব্দটাকে এমন অর্থে ব্যবহার করে যেন আড্ডা বা গুলতানির জায়গা। প্রকৃত সংস্কৃত অর্থে কিন্তু চণ্ডীমণ্ডপ হল চণ্ডীপ্রতিমার গৃহ। ক্রিকেটজীবনে বাবার উপস্থিতিও যেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে চণ্ডীমণ্ডপের ছায়া ছিল। ক্রিকেট আগেই বিসর্জিত। এ বার যে ছায়াটাও হারিয়ে গেল জীবন থেকে!
|
হৃদরোগেই মৃত্যু
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
তাঁর হাত ধরেই ময়দানের ঘাসে প্রথম পা রেখেছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। দাদা স্নেহাশিসের ক্রিকেট জীবনও তাঁকে ঘিরেই। দুই ক্রিকেটার-পুত্রের সেই গর্বিত বাবা চণ্ডী গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনাবসান ঘটল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে। বয়স হয়েছিল ৭৩। তাঁর স্ত্রী নিরূপা গঙ্গোপাধ্যায় বর্তমান। পারিবারিক সূত্রে জানানো হয়েছে, বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ চা খেতে বসেছিলেন চণ্ডীবাবু। এর আগে বেশ কয়েক দিন ধরে অসুস্থ থাকলেও এ দিন তাঁর শারীরিক অবস্থা ভালই ছিল। কিন্তু চা খাওয়ার সময় হঠাৎই অসুস্থ বোধ করেন। খুব কাশতে শুরু করেন। প্রচণ্ড অস্বস্তিতে মুখ-চোখ লাল হয়ে যায় তাঁর। শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, সেই সময়েই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এই অবস্থায় তাঁকে স্থানীয় এক বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান বাড়ির লোকজন। সেখানেই তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। চণ্ডীবাবুর মরদেহ বেহালার বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরে রাতে তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আসেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। হাসপাতালেই ছুটে গিয়েছিলেন সিএবি প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়া। যুগ্মসচিব সুজন মুখোপাধ্যায়, সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়, কোষাধ্যক্ষ বিশ্বরূপ দে-রা বেহালার বাড়িতে যান। শুক্রবার সকাল দশটায় চণ্ডীবাবুর মরদেহ নিয়ে আসা হবে ইডেনের ক্লাব হাউসে। সেখান থেকেই শেষকৃত্যের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে। |