|
|
|
|
গুড়াপের পরে |
গুড়িয়ার মতো আরও কত নীরব মৃত্যু, জানে না রাজ্য |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
গুড়াপের হোমে গুড়িয়া ও আরও দুই মানসিক রোগীর রহস্যমৃত্যুর হয়তো কিনারা হবে। শাস্তি পাবে অপরাধীরা। কিন্তু কেমন আছেন তাঁদের মতো অন্য রোগীরা? কত জনই বা মারা যাচ্ছেন মানসিক প্রতিষ্ঠানগুলোয়?
খুঁজতে গেলে উঠে আসে ভয়ানক চিত্র। মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায় একটি মেয়েদের হোমে গিয়ে মহিলা কমিশনের সদস্যরা জানতে পারেন, এক মানসিক রোগগ্রস্ত তরুণী বালিশ-তোষক ছিঁড়ে তুলো-কাপড় খেতেন। তাঁর চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থা হয়নি। কমিশনের যাওয়ার এক মাস আগে পেটের রোগে ভুগে তাঁর মৃত্যু হয়।
এই শীতে বহরমপুর মানসিক হাসপাতালে মারা গিয়েছেন তিন জন। কী করে, কী চিকিৎসা হয়েছিল, সে বিষয়ে হাসপাতাল থেকে কোনও তথ্য পাঠানো হয়নি স্বাস্থ্য দফতরকে। তবে হাসপাতালের কর্মীরাই জানিয়েছেন, প্রবল শীতেও অধিকাংশ রোগীর গায়ে একটি সোয়েটারও ছিল না। যাঁদের শয্যা জোটেনি, তাঁরা ঠান্ডা স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতে কম্বল গায়ে শুয়ে থাকেন। এই হাসপাতালেই ২০১১ সালে এক মাসে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এর পরে রোগীদের স্বাচ্ছন্দ্য দেখার জন্য যে কমিটি তৈরি হয়, আজ আর তার অস্তিত্ব নেই।
পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলে কুমার জানা গাঁধী আশ্রমে একই চত্বরে মহিলা ও পুরুষ আবাসিকদের রাখা হয়েছে। মানসিক রোগগ্রস্তেরাও রয়েছেন। খাতায়-কলমে ২০ জন আবাসিক দেখানো হলেও মহিলা কমিশনের সদস্যদের সামনে মাত্র ১১ জনকে দেখাতে পেরেছিলেন হোম কর্তৃপক্ষ। বলা হয়েছিল, বাকিরা ‘বেড়াতে গিয়েছেন।’ তবে তার জন্য কোনও সরকারি অনুমোদনের কাগজ তাঁরা দেখাতে পারেননি।
মানসিক রোগীদের রাখার প্রতিষ্ঠানগুলিতে গত তিন বছরে কত রোগী মারা গিয়েছেন, তা জানতে চেয়ে তথ্যের অধিকার আইনবলে স্বাস্থ্য দফতরকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। “উত্তরে বলা হয়, যাঁর কাছে তথ্য রয়েছে তিনি ছুটিতে গিয়েছেন। তিন মাসেও পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি,” জানান সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়। রাজ্যের পাঁচটি মানসিক হাসপাতালে প্রতি মাসে যত রোগী মারা যান, তাঁদের প্রত্যেকের মৃত্যু সংক্রান্ত নথি তাঁদের কাছে রয়েছে কি না, স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীও তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অনিরুদ্ধ দেব জানান, মানসিক হাসপাতালগুলিতে জরুরি চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থাই নেই। “মেডিক্যাল অফিসার রয়েছেন বটে, কিন্তু চিকিৎসার পরিকাঠামোর অভাবে তাঁর অবস্থা নিধিরাম সর্দারের মতো। রোগী রেফার করা ছাড়া তাঁদের কিছু করার নেই।” যে হেতু আদালতের নির্দেশে মানসিক রোগীরা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়, মৃত্যু হলে পুলিশে খবর দেওয়া এবং ময়নাতদন্ত করাই আইনত সঙ্গত। কিন্তু তা প্রায় কখনওই করা হয় না।
স্বাস্থ্য অধিকর্তা নিশ্চিত না হলেও মানসিক স্বাস্থ্য দফতরের অন্য কর্তারা অবশ্য দাবি করেন, তাঁদের কাছে সব রিপোর্টই রয়েছে। এক কর্তার কথায়, “২০১২ সালে কলকাতার লুম্বিনী ও পাভলভ হাসপাতালে একটু বেশি সংখ্যায় রোগীর মৃত্যু হয়েছিল। পাভলভে সংখ্যাটা ছিল সবচেয়ে বেশি, ২৪। লুম্বিনীতে ৯। বিষয়টা অস্বাভাবিক ঠেকায় আলাদা করে ওই দুই হাসপাতালে ‘ডেথ অডিট’ শুরু হচ্ছে। কিছু দিনের মধ্যেই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মানসিক রোগ বিভাগের প্রধান মলয় ঘোষালের নেতৃত্বে এই কাজ শুরু হবে।”
রত্নাবলীর অভিজ্ঞতা, প্রতিষ্ঠানগুলিতে সরকারি নজরদারি, পরিদর্শন, তথ্য সংরক্ষণ বা তথ্য পাঠানোর কোনও ব্যবস্থাই কাজ করে না। রোগীদের অসুখ বা দুর্ঘটনা হচ্ছে কি না, প্রয়োজনে চিকিৎসা হয় কি না, তা জানার কোনও উপায় নেই। ডাক্তার, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, টাকা-পয়সার যথাযথ বরাদ্দ ছাড়াই চলছে অনেক প্রতিষ্ঠান। বহু হাসপাতালে, হোমে আজও দেখা মেলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ, মলমূত্রে লিপ্ত রোগীর। অর্ধাহারের কারণে ভুগছেন অপুষ্টিতে, রক্তাল্পতায়। কিন্তু সংস্কার দূরে থাক, এ নিয়ে আলোচনাতেই যেতে রাজি নয় স্বাস্থ্য দফতর।
গুড়াপের মতো ভয়াবহ ঘটনা তাই এত সহজে ঘটতে পারে এ রাজ্যে। |
|
|
|
|
|