ভুল নয়। বান্ধবী রিভাকে খুন করার কুৎসিত ভাবনাই ছিল অস্কার পিস্টোরিয়াসের মনে। রীতিমতো তৈরি হয়ে ও পরিকল্পনা করে রিভা স্টিনক্যাম্পকে খুন করেন ব্লেড রানার পিস্টোরিয়াস। এমনই ধারণা রিভার মৃত্যুর তদন্তকারী পুলিশ কর্তাদের। মঙ্গলবার ভিড়ে ঠাসা প্রিটোরিয়া ম্যাজিস্ট্রেটস কোর্টে এই মামলার শুনানিতে সরকার পক্ষের আইনজীবী গেরি নেল বিচারককে সেই কথাই জানান। তিনি যখন গোটা ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন, তখন আগের দিনের মতোই কান্নায় ভেঙে পড়েন অভিযুক্ত অস্কার। তবে একটা কথাও বলেননি তিনি।
রীতিমতো নিজের নকল পা লাগিয়ে, পিস্তল বের করে, ২৩ ফুট হেঁটে এসে বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পরপর গুলি চালান অস্কার, আদালতকে জানান গেরি নেল। তাঁর যুক্তি, যদি কোনও দুষ্কৃতিই ঢুকে থাকে তাঁর বাড়িতে, তা হলে সে বাথরুমে ঢুকতে যাবে কেন? |
সরকারি আইনজীবী নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য এ দিন যতটা আটঘাট বেঁধে এসেছিলেন, অস্কারের আইনজীবী ব্যারি রু-র বক্তব্যে ততটাই পরিষ্কার যে, এখনও ঠিকঠাক গুছিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। যদিও আদালতে তিনি রীতিমতো চিৎকার করেই বলেন, “এটা আর যাই হোক কখনওই হত্যা নয়।” তবে তাঁর যুক্তি, “এমন অনেক ঘটনাই ঘটেছে, যেখানে দুষ্কৃতী ভেবে বাথরুমের মধ্যে থাকা আপনজনকে মেরে ফেলা হয়েছে। এটা অস্বাভাবিক নয়।” কিন্তু শুধু সরকারি তদন্তে নয়, কয়েকটি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের তদন্তেও উঠে এসেছে এমন কিছু তথ্য, যাতে মনে হতেই পারে এটা আকস্মিক কোনও ঘটনা নয়, বরং পূর্বপরিকল্পিত। সত্যিই যদি তা হয়, তা হলে, দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধান অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড পর্যন্তও হতে পারে অস্কারের। আপাতত তাঁকে যে বেশ কয়েক দিন জেলেই বন্দি হয়ে থাকতে হবে এই নিয়ে অবশ্য কোনও সন্দেহ নেই। এ দিন অস্কারের জামিনের আবেদন জানিয়েছিলেন তাঁর আইনজীবী রু। কিন্তু শুনানি শেষ না হওয়ায় সেই আবেদন নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত জানাতে পারেননি বিচারপতি ডেসমন্ড নেয়ার। |
|
|
|
রিভার শেষকৃত্যে তাঁর
ছবি নিয়ে জনৈক |
আদালতে অস্কারের
বাবাকে সান্ত্বনা |
পিস্টোরিয়াসের
বিমর্ষ ভাই-বোন |
|
মঙ্গলবার যখন প্রিটোরিয়ার আদালতে এই শুনানি চলছে, তখন বন্দর শহর পোর্ট এলিজাবেথের এক গির্জায় রিভা স্টিনক্যাম্পের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। সেখানে রিভার মা জুন স্টিনক্যাম্প বলেন, “আমার ফুটফুটে মেয়েটাকে কেন এ ভাবে মরতে হল, তা জানতে চাই আমি। ওর মতো সদাহাস্যময়, ছটফটে একটা মেয়েকে যে কেউ মেরে ফেলতে পারে, তা ভাবতেও পারছি না।”
ঘটনাস্থল থেকে একটি রক্তমাখা ক্রিকেট ব্যাট পাওয়া যাওয়ায় সন্দেহ আরও দানা বেঁধে উঠেছে। অস্কার তাঁর লিখিত বিবৃতিতে বলেছেন, ওই ব্যাট দিয়ে তিনি বাথরুমের দরজা ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে সেই ব্যাটে রক্ত কেন? তদন্তকারী অফিসাররা অস্কারের বেডরুমের মেঝে থেকে রিভার আই প্যাডও পেয়েছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় এক সংবাদমাধ্যম সিটি প্রেস। তদন্তে জানা গিয়েছে, আগের সন্ধ্যায় রিভা অস্কারের বাড়িতে এসেছিলেন। সঙ্গে ছিল তাঁর প্রসাধনীসামগ্রীর ব্যাগ। এই ব্যাগটিও ঘটনাস্থলে পাওয়া গিয়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের তদন্তে আবার উঠে এসেছে দুর্ঘটনার আগে দু’জনের ঝগড়ার কথাও। অস্কারের প্রতিবেশীদের বক্তব্য, রাত দেড়টার সময়ই দু’জনের ঝগড়ার আওয়াজ পান তাঁরা। |
পিস্টোরিয়াসের জবানবন্দি |
• আমরা দু’জনেই বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একটা স্লাইডিং দরজা বন্ধ করতে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় গিয়েছিলাম।
• তখন বাথরুম থেকে একটা আওয়াজ শুনে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যাই। আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তাই ঘরের আলো জ্বালাইনি। আমি জানি এ দেশে কী রকম হিংসাত্মক অপরাধমূলক ঘটনা ঘটে। নিজেও অতীতে কয়েক বার প্রাণের হুমকি পেয়েছি এবং অপরাধের শিকার হয়েছি। তাই খাটের তলায় সব সময় ৯এমএম পিস্তল রাখতাম।
• পিস্তল নিয়ে আমি বাথরুমের দিকে এগোতে এগোতে আগন্তুকের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলি, আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। রিভার উদ্দেশ্যে বলি পুলিশ ডাকতে। ভেবেছিলাম রিভা তখনও বিছানায় আছে।
• আমার প্রসথেটিক পা পরা ছিল না, তাই রিভা আর নিজের নিরাপত্তার জন্য প্রচণ্ড আশঙ্কা হচ্ছিল। বাথরুমের বন্ধ দরজার বাইরে থেকেই গুলি ছুড়ি।
• তখন প্রথম খেয়াল হয় যে রিভা বিছানায় নেই। মনে হল হয়তো ও-ই বাথরুমে আছে। বাথরুমের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করা ছিল।
• বারান্দায় গিয়ে সাহায্যের জন্য চিৎকার করি। তখনই প্রসথেটিক পা পরে নিই।
• ক্রিকেট ব্যাটের ধাক্কায় বাথরুমের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখি, রিভা আহত অবস্থায় পড়ে আছে। তখনও ও বেঁচে ছিল। ওকে বাইরে এনে প্যারামেডিক ডাকি। রিভাকে নীচে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।
• রিভাকে বাঁচানোর চেষ্টা করি, কিন্তু আমার দু’হাতের মধ্যেই ও মারা গেল। |
|
সম্ভবত, রিভার সঙ্গে এক রাগবি খেলোয়াড়ের সম্পর্ক নিয়ে অস্কার বিরক্তি প্রকাশ করেন। তার দেড় ঘন্টা পরে অস্কার বেডরুমেই প্রথমে রিভার কোমরে গুলি করেন। নিজেকে বাঁচাতে বাথরুমে ঢুকে পড়েন রিভা। বন্ধ দরজা দিয়ে নিজের ৯ মিলিমিটার পিস্তলের তিনটি গুলি এফোঁড় ওফোঁড় করে দেন অস্কার।
রক্তে স্টেরয়েডের মাত্রা বেশি হয়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত উত্তেজনার বশেও এমন কাজ করে বসেননি তো অস্কার পিস্টোরিয়াস? এমন প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে। কারণ, তাঁর ঘর থেকে মিলেছে স্টেরয়েড সংবলিত প্রচুর ওষুধও। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে পুলিশ তাঁর রক্ত পরীক্ষাও করছে। রক্তে স্টেরয়েড পাওয়া গেলে ডোপিংয়ের দায়েও পড়ে যেতে পারেন তিনি। তেমন হলে আবার তদন্তের মোড় অন্য দিকে না বাঁক নিয়ে নেয়। |