|
|
|
|
নেই বাংলা শিক্ষক, নেই পাঠ্য বই, ধুঁকছে ঝাড়খণ্ডের বাংলা স্কুলগুলি
প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায় • রাঁচি |
রাজভাষার স্বীকৃতিই সার। কাজের কাজ হয়নি কিছুই। ভগ্ন পরিকাঠামো নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে চলছে ঝাড়খণ্ডের একদা নামীদামি বহু বাংলা মাধ্যম স্কুল। কোথাও বাংলার শিক্ষক-শিক্ষিকা নেই। কোথাও বাংলা পাঠ্য পুস্তক নেই। ফলে ওই সব স্কুল ছেড়ে এখন বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা হিন্দি বা ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলিতে ভর্তি হতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলা মাধ্যম স্কুল বন্ধ করে হিন্দি বা ইংরেজি মাধ্যম চালু করতে বাধ্য হচ্ছে রামকৃষ্ণ মিশন কিংবা ভারত সেবাশ্রম সংঘের মতো প্রতিষ্ঠানও। এর ফলে প্রবাসে ক্রমেই বাংলা ভাষা অবলুপ্তির দিকে এগোচ্ছে বলেই মনে করছেন ঝাড়খণ্ডের বাঙালিরা।
দুমকা, সাহেবগঞ্জ, পাকুর, জামতারা, পূর্ব সিংভূম, ধানবাদের মতো বাঙালি অধ্যুষিত জেলাগুলির সর্বত্রই এই চিত্র। এমনকী রাজধানী রাঁচিও তার ব্যতিক্রম নয়। জামতারার কুন্ডহিত দ্বারবাসিনী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাবুলাল মন্ডলের কথায়, “স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা সাতশোরও বেশি। কিন্তু বাংলার শিক্ষক মাত্র একজন। সরকারকে বলেও কোনও লাভ হয়নি।” দুমকার বিরানব্বই বছরের পুরনো, আমজোড়া সতীশচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় কার্যত ধ্বংসের মুখে। এক সময় বহিরাগত ছাত্রছাত্রীদের জন্য হস্টেলেরও ব্যবস্থা ছিল এখানে। কিন্তু বাংলা শিক্ষার মান নেমে যাওয়ায় মাত্র ১২৫ জনে এসে ঠেকেছে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা। স্কুলের প্রধান শিক্ষক চন্দ্রেশ্বর প্রসাদ সিংহর কথায়, “বাংলা ভাষা শেষ হয়ে যাচ্ছে। কী করা যাবে। বাংলার শিক্ষকের অভাব। ছাত্রছাত্রীরা হিন্দি জানে।” |
১৯৩০ সালে স্থাপিত ধানবাদের অভয়াসুন্দরী বালিকা বিদ্যালয়।
কলকাতা থেকে বই এনে চালিয়ে যাচ্ছে লড়াই। ছবি: চন্দন পাল। |
শুধুমাত্র বাংলা পাঠ্য পুস্তকের অভাবে ধানবাদের মাইন কোয়ার্টার্স গার্লস জুনিয়র হাইস্কুলে ২০০৫ সাল থেকে বাংলা পড়ানোই বন্ধ হয়ে গেছে। সাহিত্যের শিক্ষিকা ইরানি পাঠকের কথায়, ‘‘হিন্দি থেকে অনুবাদ করে কত আর বাংলা শেখানো যায়।” ধানবাদেরই অন্য আর একটি অত্যন্ত পুরনো স্কুল, অভয়া সুন্দরী গার্লস হাইস্কুলে কোনও মতে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বই এনে এ পর্যন্ত বাংলা ভাষা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে বলে জানান শিক্ষিকা মঞ্জুলা মিশ্র। ধানবাদেরই বাংলা স্কুল পাঁররা উচ্চ বিদ্যালয়ে পঁচিশ বছর ধরে শিক্ষক পদ খালি পড়ে থাকার পরে ২০১২ সালে এলাকার বাঙালিদের চাপে সেখানে পুরুলিয়া থেকে একজন বাংলা শিক্ষককে নিয়ে আসা হয়েছে বলে জানান পার্থ সেনগুপ্ত।
জামশেদপুরের সাকচি উচ্চ বিদ্যালয়ের সম্পাদক সুজিত রায় বলেন, “একবার সরস্বতী প্রেস থেকে বই আনার ব্যবস্থা করেছিলামও। কিন্তু সরকার যদি বইয়ের বরাত না দেয় তো আমরা কী করতে পারি। আসলে এই ভাবে বাংলা স্কুলগুলি বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।” জামশেদপুরেই রামকৃষ্ণ মিশনের অধীনে লেডি ইন্দর সিংহ, সিস্টার নিবেদিতা, ভুঁইঞাডিহি রামকৃষ্ণ মিশনের মতো স্কুলগুলি বাংলা মাধ্যম তুলে দিতে বাধ্য হয়েছে। রাজধানী রাঁচির এলইবিবি হাইস্কুল কিংবা ছোটনাগপুর গার্লস স্কুলের মতো পুরনো বাঙালি স্কুলগুলিরও একই রকম করুণ অবস্থা।
ঝাড়খণ্ড বাংলা ভাষা উন্নয়ন সমিতির সংস্থাপক বেঙ্গু ঠাকুরের অভিযোগ, “বিয়াল্লিশ শতাংশ বাঙালি রয়েছে ঝাড়খণ্ডে। অথচ শুধু মাত্র বাংলা পাঠ্য বইয়ের অভাবে কত বাঙালি স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এটা বাঙালিদের শেষ করে দেওয়ার একটা চক্রান্ত। এর প্রতিবাদে আমরা রাজ্যপালকে স্মারকলিপি দিচ্ছি।” পৃথক রাজ্য গঠন হওয়ার পরে ঝাড়খণ্ডে বিজেপি নয়তো ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চাই রাজত্ব করেছে। সাঁওতাল পরগনা কিংবা অন্যান্য বাঙালি অধ্যুষিত নির্বাচন ক্ষেত্রগুলি থেকে দু’টি দলই সব সময় ভালো ভোট পায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখানে বাংলা শিক্ষার বিশেষ প্রসার ঘটেনি বলেই অভিযোগ। সাঁওতাল পরগনার বিজেপি নেতা, বাঙালি শিবলাল ঘোষ এ নিয়ে নিজের দলের বিরুদ্ধেই তোপ দেগেছেন। তাঁর অভিযোগ, “বিহার বোর্ডের অধীনে বাংলার জন্য আলাদা অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল ছিল। নতুন রাজ্যে তা ভেঙে দেওয়া হয়। সরকারের কাছে অনেক বার বলেছিলাম অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল নতুন করে তৈরি করতে। কিন্তু দলের নেতাদের একাংশের আপত্তির জেরে বাংলা শিক্ষা প্রসারের কাজ বাধা পেয়েছে।” মোর্চার সাধারণ সম্পাদক তথা প্রভাবশালি নেতা সুপ্রিয় ভট্টাচার্যের কথায়, “অনেক কষ্ট করে গত বছর বাংলাকে রাজভাষার স্বীকৃতি দেওয়ানো সম্ভব হয়েছে। আমলাদের একাংশের অসহযোগিতার কারণেই এত দেরি হল।” তবে সরকারে ফের এলে বাংলা ভাষার উন্নয়ন নিয়ে যে তাঁরা আন্তরিকভাবে কাজ করতে চান এমনটাই দাবি, দুই দলের দুই বাঙালি নেতার। |
|
|
|
|
|