|
|
|
|
কোপ পড়বে পরিকাঠামোয়, আশঙ্কা |
টাকা নেই, সব মন্ত্রকেরই বরাদ্দ কমাচ্ছেন চিদম্বরম
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
ধার করে সংসার চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে নন তিনি। এ দিকে এখনই আয় বাড়ানোর উপায় নেই। বাধ্য হয়ে তাই খরচ কমানোর পথেই হাঁটছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পালানিয়প্পন চিদম্বরম।
আগামী অর্থবর্ষের বাজেট তৈরি করতে গিয়ে চিদম্বরম কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত মন্ত্রক ও দফতরের বরাদ্দ ছাঁটাই করছেন। গত বার কেউ ১০০ টাকা পেয়ে থাকলে এ বছর বহু চেষ্টাতেও ১১০ টাকার বেশি মিলবে না বলেই খবর। কারও কারও ভাগ্য আবার আরও খারাপ। ১০০ টাকার জায়গায় ৭৫ টাকা জুটবে! প্রতিরক্ষা, জাতীয় সড়কের মতো ক্ষেত্রগুলিতে সবথেকে বেশি কোপ পড়ছে বলেই জানা গিয়েছে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক সূত্রে। চলতি বছরেও খরচ কমিয়ে টাকা বাঁচাতে চাইছেন চিদম্বরম। গত বাজেটে প্রণব মুখোপাধ্যায় পরিকল্পনা খাতে যে বরাদ্দ করেছিলেন, তার থেকে অন্তত ১ লক্ষ কোটি টাকা কম খরচ করার পরিকল্পনা নিয়েছেন তিনি।
আর এখানেই সরব হয়েছেন সমালোচকরা। অভিযোগ উঠেছে, এমনিতেই মন্দার বাজারে বেসরকারি লগ্নি কম হচ্ছে। তার উপরে যদি কেন্দ্রীয় সরকারও পরিকল্পনা খাতে ব্যয় কমিয়ে দেয়, তা হলে আর্থিক বৃদ্ধি আরও ধাক্কা খাবে। কারণ পরিকল্পনা খাতে বরাদ্দ খরচ হয় সড়ক-সেতুর মতো পরিকাঠামো বা নতুন সম্পদ তৈরিতে। সেগুলি ধাক্কা খাবে বলেই আশঙ্কা। গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ এ নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন।
রমেশের যুক্তি, গ্রামীণ পরিকাঠামোয় খরচ কমালে অর্থনীতির আখেরে ক্ষতিই হবে। এমনকী ডয়েশ ব্যাঙ্কের রিপোর্টেও বলা হয়েছে, যখন বেসরকারি বিনিয়োগের করুণ দশা, তখন পরিকাঠামো ব্যয়ে সমঝোতা করা অর্থনীতির জন্য ভাল নয়। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপিকা জয়তী ঘোষের যুক্তি, “আমেরিকা-ইউরোপের দিকে তাকিয়ে না থেকে ইউপিএ-সরকারের উচিত পরিকাঠামোয় নজর দেওয়া।” কিন্তু চিদম্বরমের পাল্টা যুক্তি, ঘাটতি লাগামছাড়া হলে দেশি-বিদেশি কর্পোরেট সংস্থাগুলি এ দেশে বিনিয়োগের ভরসা পাবেন না। ফলে বৃদ্ধির সম্ভাবনা আরও ধাক্কা খাবে। অর্থমন্ত্রীর মন্ত্র হল, বরাদ্দ কমাও, কিন্তু সঠিক জায়গায় টাকা কাজে লাগাও। |
পরিকল্পনা খাতে ব্যয় বরাদ্দ |
• ২০১১-১২ |
৪.৪১ লক্ষ কোটি টাকা |
|
• ২০১২-১৩ |
৫.২১ লক্ষ কোটি টাকা |
• ২০১৩-১৪ |
? |
* পঞ্চবার্ষিকী যোজনায় বরাদ্দ হওয়ার কথা ৫.৮৩ লক্ষ কোটি টাকা |
|
তাঁর এই যুক্তিতে অবশ্য রাজনীতির চিঁড়ে ভিজছে না। লোকসভা ভোটের আর দেড় বছরও বাকি নেই। কংগ্রেসের অন্দরমহল থেকে তাই দাবি উঠেছে, সামাজিক উন্নয়ন ও গ্রামোন্নয়ন খাতে আরও টাকা বরাদ্দ করা হোক। তাই একশো দিনের কাজ, জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন, প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা-র মতো যে সব প্রকল্পে ইউপিএ-সরকার কৃতিত্ব দাবি করে, অন্তত সেই প্রকল্পগুলিতে বরাদ্দ সামান্য বাড়াতে রাজি হয়েছেন চিদম্বরম। অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর, সব মিলিয়ে সামাজিক খাতে বরাদ্দ মেরেকেটে ৬% বাড়বে। খাদ্য সুরক্ষা আইন চালু করার জন্যও বাজেটে প্রাথমিক ভাবে ৫ হাজার কোটি টাকার অর্থ সংস্থান রাখা হবে। প্রতি বছরের মতো খাদ্যে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ অবশ্য থাকছে বলেই জানা গিয়েছে।
গত সপ্তাহেই কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন চিদম্বরম। সেখানে অনেক নেতাই অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন তোলেন, কংগ্রেস যদি ক্ষমতাতে না ফেরে, তা হলে ঘাটতি কমিয়ে কার লাভ? যোজনা কমিশনের উপাধ্যক্ষ মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়াও চাইছিলেন, পরিকল্পনা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হোক। দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী যোজনা অনুযায়ী, ২০১৩-’১৪ সালে পরিকল্পনা খাতে ৫.৮৩ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হওয়ার কথা। চিদম্বরম বেঁকে বসলে পরিকল্পনা তৈরির পরিশ্রমটাই মাটি। শেষে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে নিমরাজি হয়েছেন চিদম্বরম। তবে মন্টেক যতটা চাইছেন, ততখানি অর্থ বরাদ্দ সম্ভব হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। খুব বেশি হলে এ বার এই খাতে বরাদ্দ ৫.৫০ লক্ষ কোটি টাকা হতে পারে। এই বরাদ্দ থেকেই কেন্দ্রীয় প্রকল্প এবং রাজ্যগুলিকে সাহায্য করা হবে।
গত বাজেটে পরিকল্পনা খাতে ৫.২১ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। গত এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত যার প্রায় ৫৭% অর্থ খরচ হয়েছে। অর্থবর্ষের শেষ তিন মাসে বরাদ্দের ৩৩ শতাংশের বেশি খরচ করা যায় না। চিদম্বরম বলছেন, সারা বছর টাকা খরচ না হলে শেষ বেলায় তাড়াহুড়ো করে, জোর করে খরচ করার দরকার নেই। তাতে টাকাটাই জলে যায়। এইচডিএফসি ব্যাঙ্কের অর্থনীতিবিদদের হিসেব, অর্থমন্ত্রী এই নীতি নেওয়ায় বরাদ্দের থেকে প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা কম খরচ হবে। রাজকোষ ঘাটতিকে ৫.৩%-র লক্ষ্যমাত্রায় বেঁধে রাখতে যা অনেকটাই সাহায্য করবে।
গত সেপ্টেম্বর থেকেই অবশ্য কার্পণ্য দেখানো শুরু করেছিলেন চিদম্বরম। নতুন নিয়োগ, পাঁচ তারা হোটেলে সম্মেলন, নতুন গাড়ি কেনা, বিদেশ সফরে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু হয়। এর সবটাই পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে ব্যয়। সেখানে ১০% ব্যয় কমাতে চাইছেন তিনি। কিন্তু সমস্যা হল, পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে ব্যয়ের সবথেকে বড় অংশ, সরকারি কর্মচারীদের বেতন-পেনশন কমানো সম্ভব নয়। তাই উপায় না দেখে এ বার পরিকল্পনা খাতে ব্যয় কমাতে চাইছেন তিনি। চিদম্বরমের যুক্তি, বাজেটে যত ঘাটতি হবে, তত সরকারকে বাজার থেকে ধার করতে হবে। সরকারই যদি বাজার থেকে সব ঋণ নেয়, তা হলে বেসরকারি লগ্নিকারীরা নতুন কারখানা খোলার জন্য ঋণ পাবেন কোথা থেকে? তাঁর বক্তব্য, “বিশ্ব জুড়েই এটা মেনে নেওয়া হয়েছে, কোনও দেশের জিডিপি-র ৩ শতাংশের বেশি ঋণ নেওয়া উচিত নয়। আমি তা-ও ৫.৩% ধার করছি, যাতে পরিকল্পনা খাতে কিছু টাকা অন্তত খরচ করা যায়।” |
|
|
|
|
|