‘খোকাবাবু’র মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়েছে। পথ-নিরাপত্তা সপ্তাহে বেপরোয়া আম-নাগরিককে পথে আনতে মজাদার বিজ্ঞাপনী-ছড়া বা ফিল্মি গানের কলির প্রয়োগ আগেই শুরু হয়েছিল। এ বার কিছুটা করুণ-রসের সঞ্চার। এক ধরনের ‘ইনস্টলেশন আর্ট’-এর মাধ্যমে শহরের রাজপথে দুর্ঘটনার স্মৃতি উসকে দিতেই তৎপর লালবাজারের কর্তারা।
শহরের মোড়ে মোড়ে তাই এ বার ফিরে এসেছে দুর্ঘটনার শিকার ভাঙাচোরা গাড়ি, বাস বা মোটরবাইক। কোনও চালক হয়তো নিয়ম ভেঙে তীব্র গতিতে ওভারটেক করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন। কেউ হয়তো গাড়ি চালানোর সময়ে বিভোর হয়ে মোবাইলে কথা বলতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার। চালকের ভুলের স্মারক সেই সব গাড়িকেই রাজপথে স্থাপন করেছেন ট্রাফিক-কর্তারা। ভাঙাচোরা, ধস্ত চেহারার গাড়িগুলি দেখা যাচ্ছে শহরের অন্তত ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে। উত্তর থেকে দক্ষিণে, সিঁথির মোড়, শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়, ধর্মতলার ডোরিনা ক্রসিং, হাজরা, রাসবিহারীর মোড়, টালিগঞ্জ মেট্রো, বেহালা চৌরাস্তা, পরমা আইল্যান্ডের মতো বেশ কয়েকটি জায়গায় গেলেও চোখে পড়বে ভাঙাচোরা ওই সব গাড়ি। |
ডিসি (ট্রাফিক) দিলীপ আদক বলছেন, ভাঙাচোরা গাড়ি পেতে অসুবিধা হয়নি। দুর্ঘটনাগ্রস্ত গাড়ি নিয়মিত বাজেয়াপ্ত করা হয়। ট্রাফিক গার্ডে, থানায় বা ধাপার পিছনে পুলিশের ডাম্পিং-গ্রাউন্ডে এমন অনেক বাস-গাড়িই পড়ে থাকে। কিন্তু লালবাজারের কর্তারা চিন্তায় পড়েছিলেন, এই গাড়ির মধ্যে নিহিত বার্তাটি নিয়ে। কলকাতা পুলিশের ট্রাফিক-সচেতনতা প্রচারের মেজাজটি সাধারণত হাল্কা সুরের। পপুলার কালচার-এর অঙ্গ গানের কলি প্রয়োগে খেলাচ্ছলে শিক্ষাদান। বিটল্স-এর বিখ্যাত অ্যালবাম ‘অ্যাবে রোড’-এর কভারের ছবি পর্যন্ত উঠে এসেছে শহরবাসীকে রাস্তা ঠিক ভাবে পার হওয়ার সহবত শেখাতে। কিন্তু প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার স্মৃতি ফিরিয়ে আনা ভাঙাচোরা গাড়ির দৃশ্যে কোনও ধরনের হাল্কা মেজাজ বেমানান। তাই ভাঙা গাড়ির সঙ্গে পোস্টার, হোর্ডিংয়ে কলকাতা পুলিশের সচেতনতা-অভিযানের কাল্পনিক চরিত্র ‘খোকাবাবু’ গম্ভীর। সে শুধু বলছে, ‘চলো নিয়ম মানি’। পোস্টারে একটি সাদা ফুলের মালাও কোথাও কোথাও দেখা যাচ্ছে।
নতুন এই পোস্টার এখনও দেখেননি চলচ্চিত্রকার অনীক দত্ত। বিজ্ঞাপনের ছবিতে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সুবাদে তাঁর কিন্তু মনে হচ্ছে, এক ধরনের শক বা আতঙ্কের ধাক্কা অনেক সময়ে কোনও বার্তা পৌঁছে দিতে আসে। যেমন, সিগারেটের প্যাকেটে বা বিজ্ঞাপনে ক্যানসার-আক্রান্তদের চেহারার বীভৎস দৃশ্য। ভাঙাচোরা গাড়ি দেখেও চালকেরা হয়তো সতর্ক হবেন, এটাই আশা পুলিশকর্তাদের।
এই উপস্থাপনাটিতে এক ধরনের ট্র্যাজিক পরিণতির ছায়া দেখছেন মহাকাব্যবিশারদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি। গ্রিক ট্র্যাজেডির গল্পে মান্যগণ্য নায়কদের ভুলের পরিণতি তুলে ধরে এক ধরনের বেদনা ও ভীতির সঞ্চার করা হয়ে থাকে। শহরের রাজপথে বেপরোয়া যানবাহনের পরিণতির দৃশ্যে গ্রিক ট্র্যাজেডি অবধি না-ভাবলেও নৃসিংহপ্রসাদবাবু একটা করুণ পরিণতির ছায়া দেখছেন। “এ ভাবে কারুণ্যের উদ্রেক করলে হয়তো লোকে করুণ পরিণতি এড়াতে সতর্ক হবেন,” বলেন তিনি।
যোগেন চৌধুরীরও বিষয়টি বেশ অভিনব লেগেছে। তাঁর কথায়, “জানি না, আর কোনও শহরে পুলিশ এ ভাবে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে কি না!” তবে শুধু এতেই চিঁড়ে ভিজবে না, এটাও মনে করাচ্ছেন প্রবীণ চিত্রশিল্পী। তাঁর মতে, দুর্ঘটনা এড়াতে রাস্তাঘাট মসৃণ রাখা থেকে পথচারীদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বটাও পুলিশকেই মাথায় রাখতে হবে। |