খাতায় কলমে মঙ্গলবারই মেলা শেষ। কিন্তু এ মেলা যে বর্ধমানের ‘কেঁদুলি’। সেই জন্য তিন দিনের মেলা হলেও তা চলে এক সপ্তাহ পর্যন্ত। ‘অশান্ত’ কেতুগ্রামে গত দু’বছর ধরে সে রকম জনসমাগম হয়নি। এ বছর অবশ্য তিন দিনে গড়ে দেড় লক্ষ মানুষ ভিড় জমিয়েছে বলে মেলা পরিচালক কমিটি জানিয়েছে।
প্রায় তিন শতক আগে কেতুগ্রামের দধিয়াতে এই মেলা শুরু হয়। বর্ধমানের অন্যতম বড় মেলা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে এই মেলা। এক বৈষ্ণব সাধকের ইচ্ছাপূরণ করার জন্য দধিয়ার জঙ্গলে তাঁর শিষ্যেরা উৎসব শুরু করেছিলেন। সেই মেলাই এখন বড় আকার নিয়েছে। এই মেলা শুরুর আগে ওই বৈষ্ণব সাধকের ইচ্ছাতেই প্রত্যেক বছর ২৭ পৌষ মহোৎসব করেন। |
কেতুগ্রামে জমে উঠেছে দধিয়া মেলা। |
কথিত রয়েছে, প্রায় তিনশো বছর আগে কেতুগ্রামের দধিয়ার জঙ্গলে বৈষ্ণব সাধক গোপাল দাস বাবাজি থাকতেন। আঠারো শতকে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে তাঁর ইচ্ছে ছিল ভক্তদের কাছে চাল, ডাল যোগাড় করে ২৭ পৌষ মহোৎসব করবেন। ভক্তদের থেকে তিনি তা যোগাড়ও করেন। কিন্তু মহোৎসবের আগেই তিনি দেহত্যাগ করেন। সাধকের শিষ্য ও ভক্তের দল তাঁর ইচ্ছাপূরণের জন্য এগিয়ে আসেন। তবে ২৭ পৌষের বদলে গোপাল দাস বাবাজির স্মরণে শুক্লা সপ্তমীতে উৎসবের সূচনা হয়। উৎসবের মূল তিন দিন ভক্তদের মধ্যে চিড়ে ও অন্ন বিতরণ করে গোপাল দাস বাবাজি ট্রাস্টি। এই ট্রাস্টির সম্পাদক ভীষ্মদেব মণ্ডল বলেন, “বর্ধমান, নদিয়া, বীরভূম ও দুই চব্বিশ পরগণায় গোপাল দাস বাবাজির প্রচুর ভক্ত রয়েছেন।”
ওখানকার মেলা পৃথকভাবে পরিচালনা করেন গোপাল দাস বাবাজি ট্রাস্টি ও কেতুগ্রাম ১ ব্লকের স্থানীয় পালিটা পঞ্চায়েত। ১৯৭৯ সালের পর থেকে এ ভাবেই দু’পক্ষ নিজেদের মত করে মেলা চালিয়ে আসছে। ব্যবসায়ীদের থেকে কর আদায় করা হয়। তা দিয়ে ট্রাস্টি গোপাল দাস বাবাজির মন্দির ও সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের উন্নয়ন ঘটানো হয়। অন্য পঞ্চায়েত ওই টাকায় মেলা সংলগ্ন এলাকার পরিকাঠামোগত উন্নয়ন করে বলে দাবি করেছেন। কিন্তু মেলার পরিকাঠামো নিয়ে মানুষজনের মধ্যে প্রচুর ক্ষোভ রয়েছে। ব্যবসায়ীরাও ক্ষুব্ধ। |
বীরভূমের লাভপুর থেকে পঞ্চাশ বছর ধরে এ মেলায় আসছেন ফণিভূষণ দে। তাঁর অভিযোগ, “মেলার পরিকাঠামো নিয়ে অনেক সমস্যা রয়েছে।” নদিয়ার নবদ্বীপের দিলীপ ভট্টাচার্য, হাওড়ার সালকিয়ার সুরজিৎ কর্মকার, মুর্শিদাবাদের সাহেবনগরের বিপ্লব চক্রবর্তীদের অভিযোগ, “জলের কোনও ব্যবস্থা এ মেলাতে নেই বললেই চলে। পঞ্চায়েত ও মেলা কর্তৃপক্ষের এ দিকে নজর দেওয়া উচিত।” শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। তাই দর্শনার্থীদের ভরসা পুকুরপাড়। পালিটা গ্রাম পঞ্চায়েতের সচিব রফি আহমেদ বলেন, “আমরা অনেক সমস্যা মিটিয়ে ফেলেছি। বাকি সমস্যা আস্তে আস্তে মিটিয়ে ফেলব।”
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বীরভূমের অজয়ের পাড়ে কেঁদুলিতে যেমন ‘আখড়া’ বসে, তেমনি দধিয়াতেও আখড়া বসান সাধু-সন্ন্যাসীর দল। কেঁদুলির মত এখানেও ‘কণ্ঠি বদল’ করে জীবনসঙ্গী খুঁজে নেন বৈষ্ণব সাধকেরা। এ বছর পাঁচশো আখড়া বসেছে। তাঁরা মেতে উঠেছেন বাউল গানে। পিচ রাস্তা থেকে মেলার মূল চত্ত্বর পর্যন্ত রাস্তার সমস্যা রয়েছে। কিন্তু সব সমস্যাকে পাশে রেখে মানুষ যে প্রতি বছর মেলায় ভিড় জমাবেন তা দধিয়ার মানুষ জানেন। কারণ এ মেলা যে বর্ধমানের ‘কেঁদুলি।’ |